বিজ্ঞানীদের মতে, প্রায় ১৩.৫ বিলিয়ন বছর আগে বিগ ব্যাং এর ফলে আর্বিভুত হয় শক্তি, পদার্থ সময় ও স্থান। প্রায় ৩শত ৮০ কোটি বছর আগে পৃথিবী নামক একটি গ্রহে নির্দিষ্ট অনু মিলে জীবন নামের বেশ বড়সড় ও যৌগিক কাঠামো তৈরি হতে শুরু করে।
Thank you for reading this post, don't forget to subscribe!আজ থেকে প্রায় ৭০ হাজার বছর আগে বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লব ইতিহাসের চাকা ঘোরাতে শুরু করে। প্রায় ১২/১৩ হাজার বছর আগে শুরু হওয়া কৃষিবিপ্লব এই গতিকে ত্বরান্বিত করে। আর মাত্র ৫শত বছর আগে শুরু হওয়া বৈজ্ঞানিক বিপ্লব হয়তো চলমান ইতিহাসের সমাপ্তি ঘটিয়ে আগামীতে আবির্ভাব ঘটাবে সম্পূর্ণ ভিন্ন কিছুর।
প্রাণীজগত বা জীবজগতের মধ্যে মানুষের শীর্ষস্থান দখলের পেছনে অন্যতম প্রধান ভূমিকা রেখে আগুনের আবিষ্কার ও আগুনকে বশে রাখার দক্ষতা। আগুনের ব্যবহার মানুষকে আর অন্য প্রাণীদের মধ্যে বিশাল ব্যবধানের সৃষ্টি করেছে। কেননা, অন্য প্রায় সকল প্রাণীরই শক্তি নির্ভর করে, তার শক্তি সামর্থ্যরে উপর। তাই আগুনের আবিষ্কার নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমেই মানুষের উদ্ভাবনী সক্ষমতার প্রথম প্রকাশ।
মানবজাতির আদিকাল থেকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে ভিত্তি করেই সভ্যতার ক্রমবিকাশ বা উত্তরণ ঘটেছে। তাই নির্দ্ধিধায় বলা যায় জ্ঞান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নব নব আবিষ্কার ও উদ্ভাবনের অগ্রগতি অগ্রগমনের ইতিহাসই সভ্যতা বিকাশের ইতিহাস। মানুষের মেধা মননের উদ্ভাবনী জ্ঞান প্রয়োগের মধ্য দিয়ে জীবন, জীবিকা ও অগ্রগমনে প্রযুক্তি ধাপে ধাপে উন্নত থেকে উন্নতর হয়েছে; আর এই উদ্ভাবনকে কেন্দ্র করেই বিকশিত হয়েছে মানবসভ্যতা। সঙ্গতই, প্রশ্ন এসে যায়-উদ্ভাবন কি? উদ্ভাবন সম্পর্কে বিশ্বের খ্যাতিমান বিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ ও সমাজ বিশ্লেষক বিভিন্ন আঙ্গিকে ধারণা দিয়েছেন। যেমন অর্থনীতিবিদ জোসেফ শুম্পেটারের মতে, উদ্ভাবন হলো সৃজনশীল ধ্বংস, যা ক্রমাগত অর্থনৈতিক কাঠামোর ভেতর থেকে বিপ্লব ঘটায় এবং ক্রমাগত পুরানোটিকে ধ্বংস করে অবিরামভাবে নতুন কিছু তৈরি করে।
ম্যানেজমেন্ট কনসালটেন্ট পিটার ড্রাকারের মতে, উদ্ভাবন হলো উদ্যোক্তার সুনির্দিষ্ট যন্ত্র। যা সম্পদ সৃষ্টির জন্য একটি নতুন ক্ষমতা দিয়ে সম্পদ সৃষ্টি করে।
অধ্যাপক ক্লেটন ক্রিস্টেনসেন মতে, উদ্ভাবন শুধুমাত্র নতুন প্রযুক্তির বিষয় নয়, এটি এমন একটি প্রক্রিয়া, যা বাজারে গ্রাহকদের দ্বারা গৃহীত পণ্য বা পরিষেবা তৈরি করতে বিভিন্ন উদ্ভাবনকে একত্রিত করে।
পদার্থবিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের মতে, বুদ্ধিমত্তার প্রকৃত চিহ্ন জ্ঞান নয়, কল্পনা। উদ্ভাবন হলো সমস্যার সমাধান এবং নতুন সম্ভাবনা তৈরি করার জন্য কল্পনা প্রয়োগের ফল।
অর্থনীতিবিদ কার্লোটা পেরেজের মতে, উদ্ভাবন কেবল প্রযুক্তির বিষয় নয়, এটি একটি সামাজিক প্রক্রিয়া যার মধ্যে প্রতিষ্ঠান, অবকাঠামো ও সমাজ যেভাবে তার সমস্যাগুলি সমাধান করতে এবং একটি ভালো ভবিষ্যত তৈরি করতে নিজেকে সংগঠিত করে। এই সংজ্ঞাগুলি বিভিন্ন দৃষ্টিকোন থেকে অন্তদৃষ্টি প্রদান করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে উদ্ভাবনের গতিশীল এবং পরিবর্তনশীল প্রকৃতির উপর জোর দেয়।
বর্ণিত ধারণা থেকে এটি স্পষ্ট যে, উদ্ভাবন হচ্ছে নতুন কিছু প্রবর্তন বা বিদ্যমান ধারণা, পণ্য বা প্রক্রিয়াকে উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত করার প্রক্রিয়া। উদ্ভাবন (ইনোভেশন), সৃজন (ইনভেনশন) এবং আবিষ্কার (ডিসকভার) এই তিনটি ধারণাকে সামগ্রিকভাবে উদ্ভাবন হিসেবে গণ্য করা হলেও প্রকৃতঅর্থে পার্থক্য অনেক। তবে, তিনটি ধারণাই আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। পৃথকঅর্থে বিশ্লেষণ করলে এটি স্পষ্ট যে, উদ্ভাবন-দক্ষতা উন্নত করে, নতুন বাজার তৈরি করে এবং বিদ্যমান পণ্য বা পরিষেবাগুলিকে উন্নত করে অগ্রগতি নিশ্চিত করে।
অন্যদিকে, সৃজন বা সৃষ্টি সম্পূর্ণ নতুন ধারণা বা সমস্যার সমাধান করে। আবিষ্কার মানুষের জ্ঞানের ভিত্তি প্রসারিত করে উদ্ভাবন ও সৃজন উভয়ের ভিত্তি দেয়। মোটাদাগে বলা যায়, উপাদানগুলো একটি অন্যটির সঙ্গে সমন্বয়মূলক সংমিশ্রণে সামগ্রিক উন্নয়ন ঘটায়। এ প্রক্রিয়ায় উদ্ভাবন প্রায়শই সৃজন ও আবিষ্কারের মধ্যে সেতু হিসাবে কাজ করে এবং ধারণাগুলোকে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য ব্যবহারিক প্রয়োগের সাথে সংযুক্ত করে।
উদ্ভাবন একটি বহুমুখী ধারণা। ক্ষেত্র বিশেষ বিভিন্ন ধরনের উদ্ভাবনের সামগ্রিক উন্নয়নে অবদান রাখে। তাই বিভিন্ন মানদন্ডের উপর ভিত্তি করে উদ্ভাবনকে শ্রেণীবদ্ধ করা যেতে পারে। তবে সাধারণভাবে উদ্ভাবনকে ৪টি শ্রেণীকরণে বিভক্ত করা যায়।
(১) পণ্য উদ্ভাবন: যা নতুন পণ্য এবং পরিষেবা তৈরি বা উন্নত করা। যার মধ্যে নতুন বৈশিষ্ট যুক্ত করে সম্পূর্ণ অফার হিসেবে উপস্থাপন করা।
(২) প্রসেস বা প্রক্রিয়া উদ্ভাবন: যা পণ্য উৎপাদন ও পরিষেবা সরবরাহের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত পদ্ধতি এবং সিস্টেমগুলিকে উন্নত করার ফোকাস করে। যার লক্ষ্য বর্ধিত দক্ষতা, উৎপাদন খরচ হ্রাস এবং উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করা।
(৩) সাংগঠনিক উদ্ভাবন : যা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সামগ্রিক কার্যকারিতা ও অভিযোজন যোগ্যতাকে উন্নত করতে প্রতিষ্ঠানের কাঠামো, ব্যবস্থাপনা অনুশীলন ও ব্যবসায়িক মডেল পরিবর্তনকে বুঝায়।
(৪) বিপনন উদ্ভাবন: যা পণ্য বা পরিষেবার বর্তমান অবস্থান ও বিপননের পরিবর্তন করে মার্কেটর ক্ষেত্রে নির্ধারিত গ্রাহকের ভিত্তি করে নতুন বিতরণ ও বিপনন পদ্ধতি প্রবর্তন এবং নতুন বাজার খোঁজা ও বিপনন কৌশল অবলম্বনে উৎসাহিত করার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। শিল্প, অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট এবং সামাজিক চাহিদার উপর নির্ভর করে নির্দিষ্ট মিশ্রণ পরিবর্তিত হতে পারে। উদ্ভাবনের জন্য সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা হলে উন্নয়নকে শুধুমাত্র দ্রুতই নয় বরং তা টেকসই এবং সুসংহত হবে।
উদ্ভাবন ও উদ্ভাবনী ক্রিয়াকলাপ এবং পদ্ধতিগুলো নতুন ধারণা, প্রযুক্তি ও সমস্যার সমাধানগুলো প্রবর্তন করে সামাজিক পরিবর্তন এবং বিকাশের অগ্রগমনের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সৃজনশীলতাকে উৎসাহিত করে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় দক্ষতা বাড়ায়। সর্বোপরি, উদ্ভাবনী ভাবনা শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও টেকসই উন্নয়নের মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইতিবাচক রূপান্তরে অবদান রাখে। উদ্ভাবন উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, জীবনমান উন্নত ও সকল সম্প্রদায়ের ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে অবদান রাখে, যার ফলে দীর্ঘমেয়াদি সামাজিক অগ্রগতি সাধিত হয়।
দেশের ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় বেকার যুব সমাজের কর্মসংস্থানের জন্য লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে কোন প্রক্রিয়ায় বা পদ্ধতিতে কোটি কোটি বেকারের কর্মসংস্থান করা হবে? পরিসংখ্যানের তথ্য মতে, প্রতিবছর প্রায় ২২ লক্ষ যুবক-যুবতী কর্মে প্রবেশে সক্ষমতা অর্জন করে। কিন্তু তাদের অধিকাংশের কর্মসংস্থান হয় না। ফলে অব্যাহতভাবে বিশাল বেকারত্ব সৃষ্টি হচ্ছে। এমনি পরিস্থিতিতে বেকারত্ব হ্রাস করতে হলে অবশ্যই পরিকল্পিতভাবে উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে সরকারকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। উদ্যোক্তা বিকাশ ও উন্নয়নে উদ্ভাবন মূল ভূমিকা পালন করতে পারে।
উদ্যোক্তা উন্নয়নের জন্য উদ্ভাবনের গুরুত্বের মধ্যে যে বিষয়গুলো মোটাদাগে বিবেচনায় নেয়া যায়, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য-
উদ্ভাবন উদ্যোক্তাদের একটি প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা প্রদান করে, যা বাজারে তাদের পণ্য বা পরিষেবাগুলিকে উন্নততর হিসেবে চিহ্নিত করে।
উদ্ভাবনী কৌশল ও দৃষ্টিভঙ্গি উদ্যোক্তারা গতিশীল বাজারে প্রাসঙ্গিক থাকতে, গ্রাহকের চাহিদা এবং পছন্দ পরিবর্তন করতে পারে।
উদ্যোক্তাদের যে কোন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা ও সকল বাধা অতিক্রমসহ সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করতে এবং উদ্ভাবন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূুমিকা পালন করে।
উদ্ভাবন ও উদ্ভাবনী প্রক্রিয়া প্রযুক্তির ব্যবহারে অপারেশনাল দক্ষতা অর্জনে, উৎপাদন খরচ কমাতে পারে এবং সামগ্রিক ব্যবসায়িক কর্মক্ষমতা উন্নত করতে পারে।
উদ্ভাবন নতুন ব্যবসার সুযোগের দ্বার উন্মুক্ত করে, উদ্যোক্তাদের নতুন বাজার অন্বেষণ করতে এবং বাজারের নিজস্ব স্ট্রিম তৈরি করতে সাহায্য করে।
দ্রুত বিকাশমান ব্যবসায়িক ল্যান্ডস্কেপে, উদ্ভাবন উদ্যোক্তাদের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে খাপ খাইয়ে নিতে এবং উদীয়মান প্রবণতাকে আলিঙ্গন করতে সহায়তা করে।
উদ্ভাবন উদ্যোক্তাদের পণ্য বা পরিষেবা অফার করতে দেয় যা গ্রাহকের প্রত্যাশাকে আরও ভালভাবে পূরণ করে, যার ফলে সন্তুষ্টি এবং বিশ্বস্ততা বৃদ্ধি পায়।
উদ্ভাবন পণ্য ও পরিষেবা বৈচিত্র্যকরণ এবং ক্রমাগত বিকাশের মাধ্যমে উদ্যোক্তাদের অপ্রচলিত পণ্য বা ব্যবসায়িক স্থবিরতা সম্মুখীন হওয়ার ঝুঁকি কমাতে পারে।
উদ্ভাবন একটি শক্তিশালী ব্রান্ড ইমেজ তৈরিতে অবদান রাখে। কেননা, গ্রাহকরা প্রায়ই নতুন নতুন উদ্ভাবনী পণ্যের প্রতি নির্ভরশীল ও বিশ্বস্ত হয়ে পড়ে।
উদ্ভাবন প্রতিশ্রুতিশীল শীর্ষ প্রতিভা কর্মীর সৃজনশীলতাকে উৎসাহিত করে এবং এসব প্রতিভাবান কর্মীরা শিল্পের অগ্রগতির অগ্রভাগে থাকে এমন কোম্পানির জন্য কাজ করতে আগ্রহী থাকে।
একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য উদ্ভাবনই সমাজ ও রাষ্ট্রের অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান ভূমিকা পালন করে, যার মধ্যে উল্লেখ্য-
(ক) উদ্ভাবন হল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল চালিকা, নতুন শিল্পের বিকাশকে উৎসাহিত করে এবং সামগ্রিক সম্প্রসারণ অবদান রাখে।
(খ) উদ্ভাবনী প্রযুক্তি এবং উৎপাদনশীলতা বাড়ায়, যার ফলে সম্পদের আরও দক্ষ ব্যবহার এবং অর্থনৈতিক আউটপুট বৃদ্ধি পায়।
(গ) উদ্ভাবন প্রায়ই নতুন ব্যবসা ও শিল্পের সৃষ্টি করে, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে এবং বেকারত্বের হার কমায়।
(ঘ) যে অর্থনীতি উদ্ভাবনকে অগ্রাধিকার দেয়, তা বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগিতামূলক হওয়ার সম্ভাবনা বেশি, বিনিয়োগ এবং ব্যবসায়িক অংশীদারদের আকর্ষণ করে।
(ঙ) উদ্ভাবন টেকসই অনুশীলনের বিকাশ, সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করে
(চ) একটি উদ্ভাবনী পরিবেশ উদ্যোক্তাকে উৎসাহিত করে, স্টার্টআপ এবং ছোট ব্যবসার বৃদ্ধিকে উৎসাহিত করে, যা অর্থনৈতিক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্যভাবে অবদান রাখে।
(ছ) জীবনের মান উন্নয়নে স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা এবং প্রযুক্তিতে উদ্ভাবন নাগরিকদের জীবনের সামগ্রিক মান উন্নত করতে পারে সামাজিক কল্যাণে অবদান রাখতে পারে।
(জ) অবকাঠামো উন্নয়নে উদ্ভাবন করে, যেমন পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা, যা অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
(ঝ) নতুন ও উদ্ভাবনী পণ্য বা পরিষেবাগুলি রাজস্ব স্ট্রীম তৈরি করতে পারে, কর ও অন্যান্য ট্যাক্স আদায়ের মাধ্যমে সরকারি রাজস্বে অবদান রাখতে পারে।
(ঞ) পরিবর্তনের সাথে উদ্ভাবনী অর্থনীতিগুলি দীর্ঘমেয়াদে স্থিতিস্থাপকতা এবং স্থায়িত্ব প্রতিষ্ঠা করে, বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক পরিবর্তন এবং চ্যালেঞ্জগুলির সাথে খাপ খাইয়ে নিতে আরও ভালভাবে সজ্জিত।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে বাংলাদেশের ন্যায় অগ্রসরমান দেশের আর্থ-সামাজিক ক্রিয়াকলাপে উদ্ভাবনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। বিকাশমান অর্থনীতির অগ্রগমনে উদ্ভাবন নীতি প্রযুক্তি ও শিল্পকে বিকশিত করে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ও অর্থনীতির সম্প্রসারণে অবদান রাখতে পারে। উদ্ভাবন ও উদ্ভাবনী কার্যক্রম শিল্প, স্টার্টআপের প্রতিষ্ঠা-বিকাশ এবং ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃজনে উদ্যোক্তাকে উৎসাহিত করার পাশাপাশি শিল্পের বৈচিত্র্যকে উৎসাহিত করে; যা সচরাচর খাতের উপর নির্ভরতা হ্রাস করে। এই বৈচিত্র্য অর্থনীতির বাহ্যিক অস্থিরতা মোকাবেলা করে স্থানীয় অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সহায়ক ভূমিকা রাখে। উদ্ভাবন পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ও পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সমস্যার সমাধানে বাস্তবমুখী দিক নির্দেশনা দেয়ায় যে কোন দেশের টেকসই আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে সহায়ক।
এছাড়া, উদ্ভাবন ও উদ্ভাবনী কার্যক্রম দেশের নাগরিকদের জীবনমান উন্নয়ন, বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্টকরণ, প্রতিভা বিকাশ ও উৎসাহিত করাসহ প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের সাথে অভিযোজনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। দ্রুত পরিবর্তনশীল বৈশ্বিক পরিমন্ডলে যে সব দেশ উদ্ভাবনকে অগ্রাধিকার দিয়েছে, ঐ সকল দেশ বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে সফল এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সুদৃঢ় অবস্থান নিশ্চিত করতে পেরেছে। সামগ্রিক বিবেচনায় বলা যায়-বাংলাদেশকে একটি গতিশীল এবং অগ্রগামী চিন্তাশীল জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে একটি জাতীয় উদ্ভাবনী নীতি প্রণয়ন অত্যন্ত জরুরী।
ওয়ার্ল্ড ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টি অর্গানাইজেশন (ডব্লিউআইপিও) প্রতিবছর বৈশ্বিক উদ্ভাবনী সূচকের প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে একটি দেশের অবস্থান নির্ণয়ে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, মানবসম্পদ ও গবেষণা, অবকাঠামো, পরিশীলিত বাজার ও ব্যবসা, জ্ঞান ও প্রযুক্তি, সৃজনশীলতাসহ মোট সাতটি সূচকের মূল্যায়ন করা হয়। বৈশ্বিক উদ্ভাবনী সূচক বা গ্লোবাল ইনোভেশন ইনডেক্সে (জিআইআই) ২০২৩ সালে তিন ধাপ পিছিয়েছে বাংলাদেশ। ২০২২ সালে জিআইআই সূচকে ১৩২টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১০২তম। চলতি বছরও ১৩২টি দেশের মধ্যে তিন ধাপ পিছিয়ে ১০৫তম অবস্থানে নেমে এসেছে। এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ র্যাঙ্কিংয়ে ভারত, শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের চেয়ে পেছনে রয়েছে। তবে নেপালের চেয়ে কিছুটা এগিয়ে আছে। যা উদ্বেগজনক।
জাতীয় উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির জন্য উদ্ভাবন ও উদ্ভাবনী চিন্তা ভাবনা বিস্তৃত করা ব্যতিত কোন বিকল্প নেই। উদ্ভাবনের সংস্কৃতিকে উৎসাহিত করে গবেষণা ও উন্নয়নে সহায়তা এবং উদ্ভাবনী সমস্যা সমাধানের প্রয়োগের বিষয়টি বিবেচনায় বাংলাদেশের জন্য একটি আদর্শ উদ্ভাবন নীতি প্রণয়নে জন্য যেসব ক্ষেত্রগুলো সম্বোধন করা প্রয়োজন; তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে-
(১) শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়ন ক্ষেত্রে সৃজনশীলতা, সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা এবং সমস্যা সমাধানের দক্ষতার উপর জোর দিতে সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কার করে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল এবং গণিত শিক্ষায় রাষ্ট্রকে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।
(২) গবেষণা ও উন্নয়নে বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য তহবিল এবং প্রণোদনা বরাদ্দ করা। উদ্ভাবন কার্যক্রম একাডেমিয়া, গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি খাতের মধ্যে সহযোগিতাকে উৎসাহিত করা।
(৩) গবেষণা ল্যাব, প্রযুক্তি পার্ক এবং ইনকিউবেটর সহ উদ্ভাবনকে সমর্থন করে এমন অবকাঠামো তৈরি ও আপগ্রেড করা এবং দেশব্যাপী উচ্চ গতির ইন্টারনেট এবং উন্নত প্রযুক্তির অ্যাক্সেস নিশ্চিত করা।
(৪) উদ্ভাবক ও তাদের সৃষ্টিকে রক্ষার জন্য আইপিআর আইনকে শক্তিশালী করা এবং ব্যক্তি ও ব্যবসায়ীদের ভয়ভীতি ছাড়াই বিনিয়োগ করতে এবং তাদের উদ্ভাবনী ধারণা শেয়ার করতে উৎসাহিত করতে হবে।
(৫) স্টার্টআপ ও উদ্যোক্তাদের জন্য একটি অনুকূল পরিবেশ গড়ে তোলার পাশাপাশি উদ্ভাবনী উদ্যোগ বিকাশে উৎসাহিতকরণে রাষ্ট্রীয়ভাবে আর্থিক সহায়তা, কর প্রণোদনা এবং পরামর্শদান কর্মসূচি প্রদান করে উদ্যোক্তা ইকোসিস্টেম গড়ে তুলতে হবে।
(৬) উদ্ভাবনী পণ্য ও পরিষেবাগুলোর জন্য বাজার তৈরির লক্ষ্যে নীতি প্রবর্তন করা, যেখানে সরকারি ক্রয় প্রক্রিয়ায় উদ্ভাবনী সমাধানকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
(৭) আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহের সাথে সহযোগিতায় উদ্ভাবনী জ্ঞান বিনিময়ে যৌথ গবেষণা প্রকল্প গ্রহণ এবং বৈশ্বিক উদ্ভাবনী নেটওয়ার্কসমূহে অংশগ্রহণকে উৎসাহিতকরণ।
(৮) উদ্ভাবকদের প্রতিবন্ধকতা হ্রাসে নিয়ন্ত্রক প্রক্রিয়াগুলোকে মূলধারায় নিয়ে এসে সহজলভ্য করে নিরাপত্তা ও উদ্ভাবনের ভারসাম্য রক্ষাকারী নিয়ন্ত্রক কাঠামো তৈরি করা।
(৯) কৃষি ও বস্ত্রের মতো ঐতিহ্যবাহী খাতে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ও বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা বাড়াতে উদ্ভাবনের উপায় অন্বেষণ করা।
(১০) গবেষণা ও উন্নয়নে বিনিয়োগকারী এবং উদ্ভাবনী অনুশীলনগুলো বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোর জন্য কর প্রণোদনা এবং পুরষ্কার প্রদান করে কর্পোরেট সংস্কৃতি উৎসাহিত করা।
(১১) তথ্য গোপনীয়তা ও সাইবার নিরাপত্তা বিষয়ে নীতি প্রণয়ন ও যথার্থ প্রয়োগ করে তথ্য গোপনীয়তা এবং সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করে ডিজিটাল পরিবেশে আস্থা বৃদ্ধি করে উদ্ভাবনী প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করা।
(১২) অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও জীবনমান উন্নয়নে উদ্ভাবনের গুরুত্ব সম্পর্কে শিক্ষামূলক কর্মসূচির মাধ্যমে জনসচেতনতা সৃষ্টি ও জনসাধারণকে যুক্ত করা।
জাতি হিসেবে এগিয়ে যাবার যে প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে, সেই অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য আমাদের রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারকগণ উদ্ভাবনী মনোযোগ বাড়াবেন, সেটাই জনপ্রত্যাশা হিসেবে গণ্য করা জরুরী ও গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, উদ্ভাবন আদিকাল থেকে মানবসমাজের গতিপথকে গঠনের একটি চালিকা শক্তি। ইতিহাস জুড়ে উদ্ভাবন সামাজিক বিবর্তনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটক, সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও শাসনকে প্রভাবিত করছে। আদিম হাতিয়ার থেকে শুরু অত্যাধুনিক প্রযুক্তি পর্যন্ত প্রতিটি উদ্ভাবনই একটি অমোচনীয় চিহ্ন রেখে গেছে।
উদ্ভাবন বিষয়ে উপসংহারে এভাবে বলা যায়-সমসাময়িক বিশ্বে সমৃদ্ধির জন্য উদ্ভাবনের অপরিহার্যতা বিশ্বব্যাপী সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। যে জাতি উদ্ভাবনকে স্বীকৃতি দেয় এবং অগ্রাধিকার দেয়, তারা তাদের নিজস্ব সাফল্যের স্থপতি। সৃজনশীলতাকে মূল্যায়ন করে পরিবর্তনকে সাদরে আলিঙ্গন করে এবং মানুষের বুদ্ধমত্তার শক্তিকে কাজে লাগায়, এমন একটি সংস্কৃতিকে লালন করে যে সমাজ, সেই সমাজই আজকের চ্যালেঞ্জগুলিকে মোকাবেলা করে সঠিক পথে পরিচালনা বা নেভিগেট করতে পারে এবং একটি সমৃদ্ধ আগামীর ভিত্তি স্থাপন করতে পারে।