ঝিনেদার কাগজ || Jhenedar kagoj || সত্যের আলোয় সুন্দর

২৫শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

মুকুল হয়ে সে আজাদি ফুটুক ফিলিস্তিনে 

Remove term: মুকুল হয়ে সে আজাদি ফুটুক ফিলিস্তিনে মুকুল হয়ে সে আজাদি ফুটুক ফিলিস্তিনেRemove term: গাজা_ইসরায়েল যুদ্ধ গাজা_ইসরায়েল যুদ্ধRemove term: হামাস ইসরায়েল যুদ্ধ হামাস ইসরায়েল যুদ্ধ
এম এ কবীর
১৯৪৮ সালের মে মাসে ইসরায়েলি শাসকগোষ্ঠী ফিলিস্তিনের ঐতিহাসিক ভূখন্ডের ৮০ ভাগের বেশি দখল করে নিয়েছিল। তারা শত শত গ্রাম ধ্বংস করে সাড়ে সাত লাখের বেশি ফিলিস্তিনিকে নিজেদের ভূমি থেকে তাড়িয়ে দেয়। সেই ঘটনা ফিলিস্তিনিদের জন্য ছিল মহাবিপর্যয়। সেই ঘটনার স্মরণে তখন থেকে এখন পর্যন্ত প্রতিবছরের মে মাসে ফিলিস্তিনিরা ‘নাকবা’ (আরবি ‘নাকবা’ শব্দের অর্থ ‘বিপর্যয়’) পালন করেন। এই বছর ফিলিস্তিনিরা নাকবাকে এমন একটি ‘দ্বিতীয় নাকবা’র মধ্যে স্মরণ করছে, যখন সম্ভবত ফিলিস্তিনিদের ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ংকর ও সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী ঘটনার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। প্রথম নাকবার ৭৬ বছর পর আমরা দেখতে পাচ্ছি ফিলিস্তিনিদের ক্ষত থেকে এখনো রক্ত ঝরছে। লাখ লাখ ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তুকে নিজের ভিটেমাটিতে ফিরে যাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। তাদের একেবারে মুছে ফেলার জন্য ফিলিস্তিনিদের অবশিষ্ট অঞ্চলগুলোও ইসরায়েল দখল করে নিয়েছে।
এ বছর ৭৬ বছর আগে বাস্তুচ্যুত হওয়া ফিলিস্তিনিদের বংশধরদের সেই অতীত বিপর্যয়ের বেদনাদায়ক স্মৃতি রোমন্থন করার কোনো দরকার নেই। কারণ,তারা তার চেয়েও ভয়ানক ঘটনার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। যেন ফিলিস্তিনিদের প্রত্যেক প্রজন্মের নিজেদের একটি করে নাকবার মুখোমুখি হওয়াটাই নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে এবার ইসরায়েল গাজা এবং অধিকৃত পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের শুধু ভিটেছাড়া করতে চাইছে না, তারা মূলত ফিলিস্তিনিদের ওপর গণহত্যা ও জাতিগত নির্মূল অভিযান চালাচ্ছে।
নাকবা এবং চলমান গাজা যুদ্ধের মধ্যকার যোগসূত্রটি শুধু ফিলিস্তিনিরাই যে উপলব্ধি করতে পারছে, তা নয়। ইসরায়েলের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারাও ‘দ্বিতীয় নাকবা’ নিয়ে খোলাখুলি কথা বলেছেন। ইসরায়েলের কৃষিমন্ত্রী আভি দিশতার ফিলিস্তিনিদের উত্তর দিক থেকে তাড়া খেয়ে দক্ষিণ দিকে যাওয়ার ঘটনাকে ‘গাজা নাকবা ২০২৩’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। ইসরায়েলের পার্লামেন্টের সদস্য এরিয়েল কালনার গাজায় ‘দ্বিতীয় নাকবা’ ঘটানোর আহ্বান জানিয়েছেন। গাজার ওপর চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধ সাত মাসের বেশি সময় ধরে চলছে। ইসরায়েলের হামলায় সেখানে এখন পর্যন্ত ৩৬ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। আহত ও পঙ্গু হয়েছে ৮০ হাজারের বেশি লোক। নিখোঁজ রয়েছে হাজার হাজার ফিলিস্তিনি। বাস্তুচ্যুত হয়েছে ২০ লাখের বেশি মানুষ।
গাজার এই নতুন বাস্তুচ্যুত লোকেরা মূলত ১৯৪৮ সালের নাকবায় তাড়া খেয়ে ভিটে ফেলে পালিয়ে আসা ফিলিস্তিনিদের বংশধর। নতুন করে ভিটে ফেলে পালানো ফিলিস্তিনিদের মধ্যে এমন কেউ কেউ বেঁচে আছেন, যাঁরা ১৯৪৮ সালে প্রথম নাকবার শিকার হয়েছিলেন। গত ১৫ মে-২৪ ছিল মজলুম ফিলিস্তিনিদের ৭৬তম নাকবা দিবস বা মহাবিপর্যয়ের দিন। ফিলিস্তিনিদের কাছে দিবসটি জন্মভূমি হারানো বেদনার দিন। অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর ব্রিটিশদের দখলকৃত ফিলিস্তিনি ভূমিতে এই দিনে শুরু হয় ইসরায়েলি নতুন আগ্রাসন। ইহুদিদের এই আগ্রাসন হঠাৎ করে ছিল না বরং ছিল সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা। ১৮৮২ সালে রাশিয়ায় ইহুদিদের জায়ন আন্দোলন এবং ১৮৯৭ সালে ‘জায়নিস্ট’ নামক সংগঠন গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে তারা ধীরে ধীরে ফিলিস্তিনে পাড়ি জমাতে শুরু করে। ১৯৪৮ সালের ১৫ মে ইউরোপ ও রাশিয়া থেকে আসা এসব ইহুদিরা উচ্ছেদ করে ফিলিস্তিনিদের। সেদিনই শরণার্থী হতে হয় সাড়ে সাত লাখ ফিলিস্তিনিকে। মাত্র দেড় লাখ ফিলিস্তিনি থেকে যেতে পেরেছিল নিজভূমে।
এ বছর যখন ফিলিস্তিনিরা নাকবা দিবস পালন করছে তখন গাজায় গত ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর শুরু হওয়া ইসরায়েলি গণহত্যায় নিহতের সংখ্যা পার হয়েছে ৩৬ হাজার। তবে ঘটনার শুরু ১৯৪৮ সালের ১৫ মে থেকে। সে থেকে আজ পর্যন্ত ফিলিস্তিনের ওপর হামলা, গণহত্যা, গ্রেপ্তার, টার্গেট কিলিং এবং অনবরত মানবাধিকার লঙ্ঘন করে যাচ্ছে ইসরায়েল। ৭ অক্টোবর হামাসের হামলা প্রমাণ করে ইসরায়েল নামক পেপার টাইগার পশ্চিমাদের পুঁজিবাদি, যুদ্ধবাজ দেশগুলোর প্রক্সি রাষ্ট্র হিসেবে আরব বিশ্বে টিকে আছে।
প্রশ্ন উঠতে পারে, হাজার হাজার ফিলিস্তিনীকে হত্যা ছাড়া ৭ অক্টোবরের অর্জন কী! জবাব হচ্ছে অর্জন অনেক। পশ্চিমাদের মানবতাবাদের মুখোশের আড়ালে গণহত্যা ও শিশুহত্যার আসল চরিত্র আরেকবার বিশ্বের সামনে উন্মোচিত করেছে। ইসরায়েলের কথিত নিরাপত্তার স্বার্থের কথা বলে পশ্চিমারা গাজায় গণহত্যাকে সমর্থন করছে। চার মাস ধরে নির্বিচার বোমা মেরেও যখন হামাসের প্রতিরোধ দুর্বল করা যাচ্ছে না, তখন ২০ লক্ষাধিক ফিলিস্তিনিকে খাদ্য, পানিসহ সব রকম মানবিক সহায়তা থেকে বঞ্চিত করতে জাতিসংঘের ত্রাণ তহবিলে ফিলিস্তিনিদের জন্য অর্থ সহায়তা বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা। ৭ অক্টোবর হামাসের ইসরায়েল অভিযানে জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনআরডব্লিউর সদস্যদের জড়িত থাকার ভিত্তিহীন অভিযোগে এ সংস্থায় অর্থ সহায়তা বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, কানাডাসহ পশ্চিমা ৯টি দেশ। যে সময়ে ফিলিস্তিনিদের বাঁচাতে আরও বেশি সহায়তা প্রয়োজন সে সময়ে তারা সহায়তা বন্ধের ঘোষণা দিয়ে তাদের আসল চেহারাটা দেখিয়ে দেয়।
গাজার পুরো জনগোষ্ঠীকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়ার যে বর্বরতা ইসরায়েলিরা দেখাচ্ছে, তার নজির প্রাচীন বা মধ্যযুগেও বিরল। অথচ আমেরিকা ও পশ্চিমা বিশ্ব এই গণহত্যার নিন্দা জানানোর প্রয়োজন পর্যন্ত বোধ করেনি। তাদের অবস্থান বরং দুর্বৃত্ত দেশ ইসরায়েলের পক্ষে। ইসরায়েল যে গণহত্যা চালাচ্ছে তার আর্থিক ও সামরিক সহযোগিতা আসছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে। যে যুক্তরাষ্ট্র সারা বিশ্বকে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের বুলি শেখাচ্ছে তারাই আবার ইসরায়েলে গণহত্যার পৃষ্ঠপোষক। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে যুদ্ধকালীন আইন ও মানবাধিকার নিয়ে বেশ সোচ্চার দেখা গেল। ইসরায়েল যখন অবরোধ আরোপ করে এবং চারদিক থেকে সীমান্ত বন্ধ করে, হাজার হাজার বোমা ফেলে ২ মিলিয়ন গাজাবাসীকে সমষ্টিগত শাস্তি (কালেক্টিভ পানিশমেন্ট) দিচ্ছে তা যুদ্ধকালীন আইনের মারাত্মক লঙ্ঘন এবং স্পষ্টত যুদ্ধপরাধ। কিন্তু তা নিয়ে মার্কিনিদের উচ্চবাচ্য নেই। তবে তাদের আদর্শবাদিতা যে শুধু মাত্র পছন্দদের জন্য তা গাজাবাসী বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছে। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই ডাবল স্ট্যান্ডার্ড আজ নতুন নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরেও কোরীয় যুদ্ধ, ভিয়েতনাম যুদ্ধ, ইরাক-ইরান যুদ্ধ, ইরাক-কুয়েত যুদ্ধ, আফগানিস্তান ও ইরাক দখল, সিরিয়া, লিবিয়া ও ইয়েমেন যুদ্ধসহ সব যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ হাত লক্ষ্যকরা গেছে। এমনকি যুদ্ধে এক পক্ষকে সহায়তা করে যুদ্ধকে জিইয়ে রেখে অস্ত্রের রমরমা ব্যবসা করে গেছে দেশটি।  এসব যুদ্ধকে জাস্টিফাই করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র যেসব আলোচনা তৈরি করেছে এবং যেসব দলিল প্রকাশ করেছে পরবর্তী সময় তা ভুয়া বলেই প্রমাণিত হয়েছে।
ফলে দিনকে দিন পশ্চিমাদের সামরিক আগ্রাসনকে জাস্টিফাই করার দলিল ও অন্যদিকে মানবাধিকারের বার্তার প্রতি সারা বিশ্বের মানবতাবাদী মানুষের সন্দেহ ও অবিশ্বাস তৈরি হয়েছে। এই সন্দেহ ও অবিশ্বাস থেকে সাম্প্রতিক সময়ে আমেরিকা ও ইউরোপের প্রতিটি শহরে ফিলিস্তিনে গণহত্যা বন্ধ, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার সমর্থনে হাজার হাজার মানুষকে রাজপথে নামতে দেখা যাচ্ছে। ফলে গাজা শুধু পশ্চিমাদের মুখোশ খুলে দেয়নি, বিশ্ববাসীর চেতনার জাগরণও ঘটিয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে সারা বিশ্বের পাশাপাশি ফিলিস্তিনে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা এবং ইসরায়েলের দখলদারত্বের অবসান দাবি করে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অভূতপূর্ব ছাত্র বিক্ষোভের জন্ম হয়েছে। ছাত্র আন্দোলনের এই ঢেউ ছড়িয়ে পড়েছে আমেরিকার মর্যাদাপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয় কলাম্বিয়া, ব্রাউন, ইয়েল, হার্ভার্ড, ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি, নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস অ্যাট অস্টিন, ইউসিএলএ-সহ আরও বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে।
শিক্ষার্থীরা দাবি করেছে, যেসব কোম্পানি ইসরায়েলি দখলদারি ও গাজায় চলমান গণহত্যায় ইসরায়েলকে ফান্ড করছে, তাদের কাছ থেকে তহবিল নেয়া বন্ধ করতে হবে। মূলত যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একটি ‘ছাত্র ইন্তিফাদার’ জন্ম হয়েছে। আন্দোলনে অংশ নেয়া শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের সঙ্গে দমনমূলক অচরণ করেছে পুলিশ ও প্রশাসন। তাদের পুলিশি দমন ও নিপীড়নের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে এমনকি অনেক শিক্ষার্থীর ছাত্রত্ব বাতিল করা হয়েছে, গ্রেপ্তার হয়েছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। ফলে ইসরায়েলের ও জায়ানবাদীদের সমালোচনা থামাতে যুক্তরাষ্ট্রের আসল পরিচয় প্রকাশ পায়।
যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্বেগ উপেক্ষা করে গাজার দক্ষিণাঞ্চলীয় রাফায় বড় ধরনের স্থল অভিযান শুরু করেছে ইসরায়েল। রাফার পূর্বাঞ্চল ঘিরে ফেলেছে ইসরায়েলি ট্যাংক। পূর্ব ও পশ্চিম রাফাকে পৃথককারী মাঝামাঝি সড়কেরও নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। স্থানীয় বাসিন্দারা নগরীর পূর্ব এবং উত্তর-পূর্বে প্রায় অবিরাম বিস্ফোরণ ও গুলির শব্দের খবর জানিয়েছেন। নগরীর এ অংশে ইসরায়েলি বাহিনীর সঙ্গে ফিলিস্তিনের মুক্তিকামী সংগঠন হামাস ও ইসলামিক জিহাদের যোদ্ধাদের তুমুল লড়াই চলছে। যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট বলছে, এটি মূল্যায়ন করা যুক্তিসঙ্গত যে, যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহ করা অস্ত্র ব্যবহারে কিছু বাধ্যবাধকতা থাকলেও ইসরায়েল সেসব ‘অসংগতিপূর্ণ’ উপায়ে ব্যবহার করে থাকতে পারে। তবে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের হাতে এই সম্পর্কে যথেষ্ট তথ্য নেই বলে জানিয়েছে স্টেট ডিপার্টমেন্ট। বিবিসি জানিয়েছে, এ-সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন কংগ্রেসে জমা দেয়া হয়েছে। ইসরায়েল রাফার পূর্বাঞ্চল থেকে বেসামরিক নাগরিকদের সরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। হামলার আশঙ্কায় ইতিমধ্যে লাখো মানুষ নগরী ছেড়ে পালিয়েছে। এর আগে এই রাফাই ছিল গাজার অন্যান্য অংশ থেকে পালিয়ে আসা ১০ লাখেরও বেশি মানুষের আশ্রয়স্থল।
গত সপ্তাহের ইসরায়েল ডেমোক্রেসি ইনস্টিটিউটের এক জরিপে বলা হয়েছে, ৬২ শতাংশ ইসরায়েলি রাফায় অভিযানের পরিবর্তে জিম্মিদের ফিরিয়ে আনায় প্রাধান্য দেয় এবং শুধু ৩২ শতাংশ হামলা চালানোর পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। চ্যানেল ১৩-এর একটি জরিপে দেখা যায়, ৫২ শতাংশ ইসরায়েলি ‘পুরোপুরি বিজয়’ অর্জিত হবে না বলে মনে করে। সরকারের ‘পুরোপুরি জয়ের’ নেশা ইসরায়েলের ইতিহাসে দেশটিকে বৈশ্বিকভাবে সবচেয়ে বেশি বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। বাইডেনের ঘোষণার আগে কানাডা ও ইতালি দেশটিতে নতুন করে অস্ত্র রপ্তানি বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছিল। কলম্বিয়া কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। তুরস্ক বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, যা এখনও বাতিল হতে পারে। আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত নেতানিয়াহুকে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে। আর ইসরায়েলে নিজ দেশেই ১ লাখ মানুষ পালিয়ে বেড়াচ্ছে। যুদ্ধের কারণে তাদের আয় ও মানসিক স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ছে। অসম্ভব হলেও গাজায় ‘পুরোপুরি জয়ে’র আশায় মৃত সেনাদের কারণে প্রতিদিন অসংখ্য পরিবার শোকাচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে।
চলতি মাসের ১০ তারিখ ছিল জাতিসংঘে ফিলিস্তিনের সদস্যপদ নিয়ে ভোটাভুটির দিন (ফিলিস্তিনকে জাতিসংঘের ১৯৪ তম সদস্যপদ দেয়ার জন্য নিরাপত্তা পরিষদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে সাধারণ পরিষদে একটি প্রস্তাব পাস হয়েছে। প্রস্তাবটির পক্ষে ভোট পড়েছে ১৪৩ টি; বিপক্ষে ৯টি দেশ)। আরব বিশ্ব বারবার বলে আসছে– তারা দ্বিরাষ্ট্রীয় প্রশ্নের সমাধানে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে প্রস্তুত। ২০০২ সালে আরব শান্তি উদ্যোগে যেমন এ বিষয়টি আলোচিত হয়, তেমনি ২০২৩ সালে আরব-ইসলামী শীর্ষ সম্মেলনেও এর ওপর জোর দেয়া হয়। যুদ্ধ বন্ধ করে মধ্যপ্রাচ্যে স্বাভাবিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার পথ স্পষ্ট।
১৯৬৭ সালের সীমান্ত অনুসারে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকার করে নিতে হবে। একই সঙ্গে পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী মেনে মুসলমানদের পবিত্র স্থানগুলো ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণমুক্ত করতে হবে। এর পর ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন এবং ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন উভয়েরই নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে। বিশ্বের অধিকাংশ দেশই দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধানে একমত। কারণ এটি আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত এবং জাতিসংঘের রেজুলেশনে অন্তর্ভুক্ত। এখন বিশ্বের ১৯৩ টি দেশের মধ্যে ১৪৩টি দেশ ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। অথচ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন পর্যন্ত জাতিসংঘে ফিলিস্তিনের সদস্যপদ আটকে রেখেছে।
তিনটি দেশ বার্বাডোজ, জ্যামাইকা অ্যান্ড ত্রিনিদাদ ও টোবাগো সম্প্রতি ফিলিস্তিনের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছে, আবার সাধারণ পরিষদে ফিলিস্তিনের সদস্যপদের পক্ষে ভোটও দিয়েছে। ফিলিস্তিনের যে রাজনৈতিক অধিকার রয়েছে, তার পক্ষে বিশ্ব সম্প্রদায়ের ঐকমত্যের আলামত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও অন্যান্য দেশের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের প্রতিবাদেও স্পষ্ট। শিক্ষার্থীরা ফিলিস্তিনে বর্ণবৈষম্য ও গণহত্যা দেখছে এবং তার বেদনাও ভালোভাবে অনুভব করছে। সে জন্যই তারা এ সংকটের অবসানে সক্রিয়ভাবে আন্দোলন করছে।
১৮ এপ্রিল নিরাপত্তা পরিষদে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের পক্ষে যে ভোট হয়, সেখানে ১৫টির মধ্যে ১২টি দেশ ফিলিস্তিনের পক্ষে ভোট দিলেও ভেটো দেয় যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাজ্য ভোটদানে বিরত ছিল। বস্তুত যুক্তরাষ্ট্রের ভেটোর কারণেই সাধারণ পরিষদের ১০ মে’র জরুরি অধিবেশন বসে। এখন প্রস্তাবটি আবার চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য নিরাপত্তা পরিষদে উঠবে। ইসরায়েলের নেতারা দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধানের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য ইসরায়েলের পক্ষে দাঁড়িয়েছে। কেবল এবারই নয়; দেশ দুটি বরাবরই দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধানের উদ্যোগ পন্ড করেছে। তারা ইসরায়েলের বর্ণবাদী ব্যবস্থা সমর্থন করে তাদের সহযোগিতা করে যাচ্ছে, যা গণহত্যা সংঘটন এবং অবৈধ বসতি স্থাপনকে বৈধতা দিয়েছে। ফিলিস্তিন জাতিসংঘের সদস্য হলে তা ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন উভয়ের নিরাপত্তা নিশ্চিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। আন্তর্জাতিক আইনের মাধ্যমেই শান্তি প্রতিষ্ঠা হবে এবং জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ, আরব রাষ্ট্রসহ অবশ্যই বিশ্ব সম্প্রদায়ের সমর্থনের মাধ্যমে তা পূর্ণতা পাবে।
এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে এ অবস্থা চলে আসছে। ১৯১৭ সালে ব্রিটেন ওসমানীয় সাম্রাজ্যের একটি প্রদেশকে ইহুদিদের আবাসভূমি হিসেবে ঘোষণা করে। অথচ ওই জায়গায় ব্রিটেনের কোনো অধিকার ছিল না। এর পর ৩০ বছর ধরে চলা সহিংসতা নাকবা বা ফিলিস্তিনি উচ্ছেদে রূপ নেয় এবং পরে এ নিয়ে বারবার যুদ্ধ বাধে।
১৯৬৭ সালের যুদ্ধের পর ইসরায়েল অবশিষ্ট ফিলিস্তিন ভূমি দখল করে সেখানে বর্ণবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। ইসরায়েল কঠোর নির্দয়মূলক শাসনব্যবস্থা কায়েম করে। গোঁড়া ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনি উভয়ের মধ্যে তিক্ততা বাড়ে এবং তাদের বিভাজন দিন দিন ব্যাপকতা লাভ করে। দুই রাষ্ট্রের মধ্যে কয়েক দশক ধরে যে সহিংসতা চলছে, তার অবসান ঘটানোর জন্য আমরা সত্যিকারের এক ঐতিহাসিক মুহূর্তে আছি। রাজনৈতিক কারসাজির মাধ্যমে শান্তি প্রক্রিয়াকে আর ক্ষতিগ্রস্ত করা যাবে না। দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধানের মাধ্যমেই অবিলম্বে শান্তি আসতে পারে। জাতিসংঘে ফিলিস্তিনের রাষ্ট্র হওয়াটা এ ক্ষেত্রে যাত্রাবিন্দু হিসেবে কাজ করবে, কিন্তু এটাই শেষ নয়। কূটনৈতিক এই স্বীকৃতি পারস্পরিক নিরাপত্তার জন্য আরও গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে সহায়তা করবে। ১০ মে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলো ফিলিস্তিনের পক্ষে ভোট দিয়ে আন্তর্জাতিক আইন সমুন্নত রাখা, ন্যায়বিচার ও শান্তির পক্ষে যে রায় দিয়েছে, এর মাধ্যমেই শান্তি আলোচনা শুরু হোক। আশার কথা হলো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রজন্ম তাদের পূর্বসূরিদের মতো অন্ধভাবে ইসরায়েলকে সমর্থন করছে না। তারা ফিলিস্তিনে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার পক্ষে এবং ইসরায়েলি দখলদারি ও গাজা যুদ্ধের বিপক্ষে। তারা যে চেতনার ফুল ফুটিয়েছে সে চেতনা সংক্রমিত হয়ে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে একদিন। বিশ্বজুড়ে পৃথিবীর সংগ্রামী মানুষের কাফেলা হতে থাকবে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর। যে চেতনার বলে একদিন ফিলিস্তিনে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা হবে। জেরুজালেমের আল আকসায় উড়বে স্বাধীন ফিলিস্তিনের পতাকা। সম্প্রতি ভারত, পাকিস্তানের ভাইরাল হওয়া একটি  স্লোগান সামনে আনতে চাই, ‘ তু কন ? নেহি দেগা আজাদি, তেরা বাপবি দেগা আজাদি’। মুকুল হয়ে সে আজাদি ফুটুক ফিলিস্তিনে। বিশ^ মানবতা এগিয়ে আসুক বিবেকের তাড়নায়।
লেখক: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক, কলামিস্ট ও সভাপতি, ঝিনাইদহ জেলা রিপোর্টার্স ইউনিটি

আরও পড়ুন

মিয়ানমারে লড়াইয়ের জন্য জড়ো হচ্ছে রোহিঙ্গারা

মিয়ানমারে লড়াইয়ের জন্য জড়ো হচ্ছে রোহিঙ্গারা

অনুবাদ রয়টার্স থেকে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী বসতিতে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বসবাস। ২০১৭ সালে বৌদ্ধ অধ্যুষিত মায়ানমার সরকার দেশটির

যবিপ্রবির ভিসি অধ্যাপক ড. এম মজিদের সংবর্ধণা কমিটির প্রস্তুতি সভা

হরিণাকুণ্ডুতে যবিপ্রবির ভিসি অধ্যাপক ড. এম মজিদের সংবর্ধণা কমিটির প্রস্তুতি সভা অনুষ্ঠিত

হরিনাকুণ্ড প্রতিনিধি ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডুর বরেণ্য শিক্ষাবীদ যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাইস চ্যান্সলর অধ্যাপক ড. এমএ মজিদের সংবর্ধনা প্রদান কমিটির

মানুষের ভোটার অধিকার হরণ

‘মানুষের ভোটাধিকার হরণ করে এমন স্বাধীনতা আমরা চাইনি’

মোস্তাফিজুর রহমান, কোটচাঁদপুর মানুষের ভোটাধিকার হরণ করে এমন স্বাধীনতা আমরা চাইনি। ধর্ষণ সেঞ্চুরি করে উল্লাস করে এমন স্বাধীনতা আমরা চাইনি।

দরিদ্র মেধাবী ছাত্র নীরবের পাশে মানবতার হাত

দরিদ্র মেধাবী ছাত্র নীরবের পাশে মাও. আবু তালেব

বনি আমিন, কালীগঞ্জ (ঝিনাইদহ) ঝিনাইদহের মঙ্গলপৈতা কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের এইচএসসি প্রথম বর্ষের ছাত্র সালমান ইসলাম নীরবের পড়াশোনার পথে দীর্ঘদিনের আর্থিক

কপ২৯: বছরে ৩০০ বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি পেল দরিদ্র দেশগুলো

কপ২৯: বছরে ৩০০ বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি পেল দরিদ্র দেশগুলো

ডেস্ক রিপোর্ট দীর্ঘ দর-কষাকষির পর সমঝোতায় পৌঁছেছে কপ২৯। বিশ্বের ধনী দেশগুলো প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, জলবায়ু সংকটের ঝুঁকিতে থাকা দরিদ্র দেশগুলোকে অভিযোজন