ডেস্ক অনুবাদ
Thank you for reading this post, don't forget to subscribe!জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠে পানি বেড়ে ক্রান্তীয় বা গ্রীষ্মমণ্ডলীয় নিচু দ্বীপরাষ্ট্রগুলো ডুবে যাবে বলে দীর্ঘদিন ধরে আশঙ্কা জানিয়ে আসছেন বিজ্ঞানীরা। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় গবেষকেরা কিছু চমকপ্রদ তথ্য পেয়েছেন। গবেষণায় দেখা গেছে, ঝুঁকিপূর্ণ বলে বিবেচনা করা অনেক দ্বীপ এখনো ভালোই আছে। এমনকি সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ার পরও কোনো কোনো দ্বীপের আরও বিস্তার ঘটতে দেখা গেছে।
কয়েক দশক আগে বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ার প্রতি মনোযোগী হয় বিশ্ব। তখন আশঙ্কা জানানো হয়, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাবের প্রথম শিকার হবে প্রবালপ্রাচীরে ঘেরা দ্বীপগুলো। কারণ, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে উষ্ণতা বেড়ে মেরু অঞ্চলের বরফ গলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাবে। আর সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়লে এ দ্বীপগুলো নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।
এখন বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ার কারণে সমুদ্রের পানিও বাড়ছে। এমন অবস্থায় দ্বীপগুলোর পরিণতি জানতে কয়েক বছর আগে গবেষকেরা আকাশ থেকে তোলা ছবি খুঁটিয়ে দেখে চমকপ্রদ চিত্র পান। শুরুতে তাঁরা ডজন দুয়েক দ্বীপের ছবি দেখেন। এরপর কয়েক শ দ্বীপ তাঁদের গবেষণার আওতায় আসে। আর এখন তা বাড়তে বাড়তে এক হাজারের কাছাকাছি। গবেষণায় দেখা গেছে, কয়েক দশকে দ্বীপের কিনারাগুলো এঁকেবেঁকে ভেঙেছে, কোথাও হয়তো ক্ষয় হচ্ছে, আবার কোথাও নতুনভাবে গড়ে উঠছে। তবে মোটের ওপর দ্বীপের এলাকা সংকুচিত হয়নি; বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে সমুদ্রের পানি বাড়তে থাকার সঙ্গে সঙ্গে দ্বীপগুলো বড়ও হয়েছে।
বিজ্ঞানীরা এর কারণ কিছুটা মাত্র আন্দাজ করতে পেরেছেন; সবটা নয়। এমন অবস্থায় বিজ্ঞানীদের একটি দল সম্প্রতি মালদ্বীপে যায়। সেখানে কয়েক সপ্তাহ কাজ করেছেন বিজ্ঞানীরা। গবেষণার জন্য সেখানে যন্ত্রপাতি, সেন্সর ও ক্যামেরা স্থাপন করেছিলেন তাঁরা।
বিজ্ঞানীরা জানার চেষ্টা করেছেন, কীভাবে নীল ঢেউ ও সাদা বালু মিলেমিশে উপকূলরেখায় আশ্চর্যজনক সব জিনিস তৈরি করে, তীরে ভাঙাগড়া চলতে থাকে। বিজ্ঞানীরা বড় একটি প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন—আশু বিলীন হওয়া যদি প্রবাল দ্বীপরাষ্ট্রগুলোর অনিবার্য ঝুঁকি না হয়, তাহলে তাদের জন্য ঝুঁকিগুলো কী?
গবেষণায় দেখা গেছে, সেখানকার কিছু দ্বীপে বাস করা কঠিন হয়ে পড়েছে। আবার কিছু কিছু দ্বীপ বসবাসের উপযোগী। বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, প্রবাল দ্বীপরাষ্ট্রগুলোর সরকারকেই ঠিক করতে হবে যে তারা এখন কোন জায়গাগুলো সংরক্ষণ করবে আর কোন জায়গাগুলোকে ছেড়ে দেবে। যে জায়গাগুলো সুরক্ষিত রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে, সেগুলো নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করতে হবে। যেমন সেখানে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা, স্কুল নির্মাণ, স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও অবকাঠামো নির্মাণের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। তাদের কাছে যে সীমিত সম্পদটুকু আছে, তা দিয়েই তাদের উন্নত ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে হবে।
প্রবালদ্বীপের আকার
টেকটোনিক প্লেটের অবস্থান পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে দ্বীপ অঞ্চলের উত্তপ্ত আগ্নেয়গিরিগুলো একসময় ঠান্ডা ও শান্ত হয়ে পানির নিচে ডুবে যায়। সেখানে প্রবাল বাসা বাঁধতে থাকে এবং উঁচু হতে থাকে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আগ্নেয়গিরিগুলো মৃত আগ্নেয়গিরিতে পরিণত হয় এবং সেখানে আংটি আকৃতির প্রবালপ্রাচীর গড়ে ওঠে। প্রতিটি প্রবালপ্রাচীর একটি উপহ্রদকে ঘিরে থাকে। প্রবালপ্রাচীরগুলো যখন যথেষ্ট উঁচুতে ওঠে, তখন বাতাস ও ঢেউয়ের তোড়ে বালু ও নুড়ি মিলে ক্ষুদ্র দ্বীপ গড়ে ওঠে। আংটি আকৃতির প্রবালপ্রাচীরবেষ্টিত এ ধরনের দ্বীপগুলোই অ্যাটল বা প্রবালপ্রাচীরঘেরা দ্বীপ হিসেবে পরিচিত।
গড়ে ওঠার পর্যায় অনুসারে এদের চেহারা নানা রকম হতে পারে। ফ্রেঞ্চ পলিনেশিয়াতে কিছু ছোট আংটির মতো আবার কিছু লম্বাকৃতির ঝোলানো গলার মালার মতো। মালদ্বীপের প্রবালপ্রাচীর ঘেরা এলাকাগুলো দ্বীপগুলো বিশাল, এবড়োথেবড়ো ও বাঁকাচোরা হয়ে থাকে। মাইক্রোনেশিয়াতে এখনো কিছু দ্বীপের মাথার ওপর খাঁড়া হয়ে আছে আগ্নেয়গিরির অবশেষ। কোনো কোনো প্রবালপ্রাচীরের ঘেরের মধ্যে ক্ষুদ্রতর ঘের থাকে। একেবারে ছোট্ট ছোট্ট ঘেরও থাকতে পারে, যেন আংটির ভেতর আংটি।
১৮৩৬ সালে ভারত মহাসাগরের প্রবালপ্রাচীর পরিবেষ্টিত একটি দ্বীপ পরিদর্শনের পর চার্লস ডারউইন লিখেছিলেন, ‘এগুলো অবশ্যই বিশ্বের চমকপ্রদ নিদর্শনের প্রথম সারিতে থাকবে।’
সর্বপ্রথম চার্লস ডারউইনই তাঁর তত্ত্বে বলেছিলেন, প্রবালপ্রাচীরের ঘেরগুলো আসলে মৃত আগ্নেয়গিরির সমাধিস্থল। পরবর্তী সময়ে বিজ্ঞানীরা বলতে থাকেন, সমুদ্রপৃষ্ঠের ওঠানামার কারণে প্রবালপ্রাচীরঘেরা এই দ্বীপগুলো যুগে যুগে কয়েকবার ডুবেছে আর জেগে উঠেছে।
গবেষণায় যা পাওয়া গেল
প্রবালপ্রাচীরঘেরা দ্বীপগুলোর কী দশা হচ্ছে, তা জানতে আর্থার ওয়েব ও পল কেঞ্চ নামের দুই গবেষক উদ্যোগী হন। তাঁরা আকাশ থেকে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের সিদ্ধান্ত নেন। এর অংশ হিসেবে এই দুই গবেষক বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে উড়োজাহাজ থেকে ধারণ করা প্রশান্ত মহাসাগরীয় ২৭টি দ্বীপের ছবি সংগ্রহ করেন। এর পর তাঁরা ছবিগুলোর সঙ্গে সম্প্রতি কৃত্রিম উপগ্রহে ধারণ করা ছবিগুলোর তুলনা করেন।
গবেষকেরা বলছেন, প্রতি দশকে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা এক ইঞ্চির মতো করে বেড়েছে। তবে ঢেউয়ের সঙ্গে সঙ্গে দ্বীপগুলোর তীরে যথেষ্ট পরিমাণে পলি জমা হতে থাকায় এগুলোর বেশির ভাগের আকার খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। শুধু হয়তো প্রবালপ্রাচীরে সেগুলোর অবস্থান পরিবর্তন হয়েছে, এগুলোর আকৃতিতে ভিন্নতা এসেছে।
বিজ্ঞানীরা আরও বলেছেন, যা কিছু ঘটতে দেখা যাচ্ছে, তাতে খুব সহজেই বলে দেওয়া যাচ্ছে না যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়লে দ্বীপগুলো নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।
গবেষক আর্থার ওয়েব ও পল কেঞ্চের করা এ গবেষণা বেরোয় ২০১০ সালে। এটা অন্য বিজ্ঞানীদের উদ্বুদ্ধ করে। তাঁরা আরও পুরোনো ছবি খোঁজা এবং আরও বেশি করে বিশ্লেষণের ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠেন।
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় এক হাজারের মতো দ্বীপে গবেষণা চালিয়ে গবেষকেরা একই ধরনের তথ্য পেয়েছেন। আর তা হলো কিছু দ্বীপ সংকুচিত হয়েছে, কিছু বড় হয়েছে। আবার অনেকগুলোকে স্থিতিশীল অবস্থায় থাকতে দেখা গেছে।
এসব গবেষণায় আরেকটি দিক উঠে এসেছে। তা হলো সাধারণভাবে মহাসাগরীয় অঞ্চলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা সবচেয়ে দ্রুত বাড়লেও সেখানকার দ্বীপগুলোয় অন্য এলাকার দ্বীপের চেয়ে বেশি ভূমিক্ষয় হয়নি।
মালদ্বীপের দক্ষিণাঞ্চলে হুভাধু নামে লাউ আকৃতির প্রবালপ্রাচীর বেষ্টনীতে ২৪১টি দ্বীপ রয়েছে।
গবেষকেরা ১৮৪টি দ্বীপে উড়োজাহাজ ও কৃত্রিম উপগ্রহের মাধ্যমে ধারণ করা ছবিগুলো পর্যালোচনা করে দেখেছেন, কীভাবে সাম্প্রতিক দশকগুলোয় এগুলোর বদল ঘটেছে।
এতে দেখা গেছে, দ্বীপপুঞ্জের প্রায় ৪২ শতাংশের ক্ষয় হয়েছে। তবে প্রায় একই অনুপাতে ৩৯ শতাংশ এলাকার অবস্থা স্থিতিশীল আছে, যদিও তাদের আকৃতির পরিবর্তন হয়েছে। আর ২০ শতাংশ দ্বীপ বড় হয়েছে। সেগুলোর কয়েকটি বড় করেছে মানুষ, নতুন জমি তৈরি করে।
বিজ্ঞানীদের একটি দল সম্প্রতি গবেষণার জন্য মালদ্বীপে যায়
বিজ্ঞানীদের একটি দল সম্প্রতি গবেষণার জন্য মালদ্বীপে যায়ছবি: এএফপি ফাইল ছবি
কেন কিছু দ্বীপের সংকোচন হয়েছে, আবার অন্যগুলোর হয়নি, তা এখন খতিয়ে দেখার চেষ্টা করছেন বিজ্ঞানীরা। প্রবালপ্রাচীর নিয়ে আরও নিবিড়ভাবে কাজ করার জন্য এ বসন্তে গবেষক কেঞ্চ আবারও মালদ্বীপে গিয়েছিলেন।
নিরক্ষরেখা থেকে মাত্র কয়েক মাইল উত্তরে একটি জঙ্গলাকীর্ণ ভূমির সৈকতের একটি অংশে গিয়েছিলেন কেঞ্চ। ওই সৈকতের কিছু অংশ সাগরের ঢেউয়ের সঙ্গে ভেসে গেছে। কয়েকটি পামগাছ উপড়ে থাকতে দেখেছেন তিনি। সেগুলোর অর্ধেকটা আবার বালুতে চাপা পড়েছে।
কেঞ্চ বলেন, ‘দ্বীপের এদিকটা নিয়ে মানুষ খুব মাতামাতি করে।’ সামনের দিকে দেখিয়ে তিনি তিনি বলেন, ‘ওই অংশ আগের চেয়ে বড় হয়েছে।’
এর আগের দিন একই প্রবালদ্বীপপুঞ্জের আরেকটি দ্বীপে গবেষণা কাজ চালিয়েছে বিজ্ঞানী ও স্নাতক শিক্ষার্থীদের একটি দল। তারা চটজলদি বয়া ভাসিয়ে স্রোত মেপেছে।
আরেকটি দল সেন্সরের সাহায্যে সৈকতের দিকে আসা ঢেউগুলো মাপজোখ করেছে।
তৃতীয় একটি দল সাগরের তলদেশে ডুবুরি হিসেবে গিয়েছিল। সেখানে তারা প্রবালপ্রাচীরে যন্ত্র বসায়। এ যন্ত্রের সাহায্যে ওপর থেকে প্রবালপ্রাচীরটিকে ভালোভাবে দেখা যাচ্ছিল।
সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষক কেঞ্চ বলেন, গবেষকেরা আশা করছেন, ধিগুলাবাধু দ্বীপ থেকে সংগ্রহ করা এ তথ্যগুলোর মাধ্যমে ভবিষ্যতে কী হতে পারে, তা নিয়ে তাঁরা ধারণা পাবেন।
বিজ্ঞানী কেঞ্চ তাঁর গবেষণায় দেখেছেন, কান্দাহালাগালা নামের আরেকটি দ্বীপে ধারাবাহিকভাবে পরিবর্তন হচ্ছে। হুভাধু নামের প্রবালপ্রাচীর বেষ্টনীর ১৯৬৯ সালের ছবিতে কান্দাহালাগালাকে দেখা গেছে। বিভিন্ন ছবির সঙ্গে তুলনা করে এর পরিবর্তন দেখা গেছে। ছবি অনুযায়ী, ২০০৫ সালে এর প্রান্ত ভাগ দক্ষিণ দিকে এগিয়েছে। এর উত্তর অংশে ক্ষয় হচ্ছিল এবং দক্ষিণ অংশ বাড়ছিল।
পরবর্তী পাঁচ বছরে দ্বীপের পূর্ব ভাগ কিছুটা ক্ষয় হতে দেখা গেছে। তখন পশ্চিম অংশের বিস্তার হয়েছিল। গত ৫০ বছরে দ্বীপটির সংকোচন ঘটেনি, এর আকারের পরিবর্তন হয়েছে শুধু।
সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়াজনিত পরিস্থিতিকে কীভাবে মোকাবিলা করতে হবে, তা নিয়ে দ্বীপ ও উপকূলবিষয়ক গবেষকেরা এখন একই ধরনের পরামর্শ দিচ্ছেন। সংক্ষেপে বললে এর অর্থ দাঁড়ায়, কিছুই করার নেই। গবেষক কেঞ্চ পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। তাঁর মতে, সমুদ্র তার নিজের মতো চলবে। মানুষকে এর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া শিখতে হবে। এর মানে হলো ব্যয়বহুল প্রকল্পের মধ্য দিয়ে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাকে না ঠেকিয়ে পানিকে ঘিরেই পরিকল্পনা সাজাতে হবে।