ফিচার ডেস্ক
Thank you for reading this post, don't forget to subscribe!চামড়ায় বাঁধানো বই কখনো দেখেননি এমন মানুষ বিরল। কিন্তু সেই চামড়া যদি মানুষের হয় তাহলে? অবিশ্বাস্য মনে হলেও এ জিনিস অবাস্তব নয় একেবারেই। রয়েছে অকাট্য প্রমাণও।
বই বাঁধাইয়ের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, মানুষের চামড়া ব্যবহার করে বেশ কিছু বই একসময় বাঁধানো হয়েছে। এই কর্মটির একটি গালভরা নামও রয়েছে- ‘অ্যান্থ্রোপোডার্মিক বিবলিওপেজি’।
২০১৯ সালের একটি হিসাব বলছে, বিশ্বের বিভিন্ন গ্রন্থাগারে ছড়িয়ে রয়েছে এমন বই। ‘অ্যান্থ্রোপোডার্মিক বুক প্রোজেক্ট’ নামের সেই সমীক্ষা জানাচ্ছে, বিভিন্ন গ্রন্থাগারের ৫০টি বইকে সন্দেহ করা হয় মানুষের চামড়ায় বাঁধানো বলে। তার মধ্যে ৩১টি সম্পর্কে সন্দেহ ঘনীভূত হয়। বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরে এগুলোর মধ্যে ১৮টিকে বিশেষজ্ঞরা নিশ্চিতভাবে মানুষের চামড়ায় বাঁধানো বলে চিহ্নিত করেছেন।
প্রায় ১০ বছর আগের কথা। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার থেকে উদ্ধার করা হয় ‘দেস দেসতিনেস দে লামে’ (ডেস্টিনিজ অব দ্য সোল) নামের একটি বই।
জানা গেছে, ১৮৮০ সালে লেখা হয় এ বইটি। আত্মা ও মৃত্যুপরবর্তী জীবন নিয়ে লেখা এ বইটির লেখক আর্সেন হোসায়ের। ১৯৩৪ সাল থেকে বইটি ছিল হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের হাফটন লাইব্রেরিতে। এরপর একটা পর্যায়ে বইটির মলাট নিয়ে সন্দেহ হওয়ার পর ব্যাপক অনুসন্ধান চালান বিজ্ঞানী ও পর্যবেক্ষকরা। অবশেষে ২০১৪ সালে এসে সিদ্ধান্তে উপনীত হতে সক্ষম হন গবেষকরা। বইটির মলাটে মানুষেরই চামড়া ব্যবহার করা হয়েছে বলে শতভাগ নিশ্চিত হন তারা।
ইউনিভার্সিটি বলেছে, বইটির প্রথম মালিক বই সংগ্রাহক, চিকিৎসক লুডোভিক বোল্যান্ড সেই সময়ে মানসিকভাবে অসুস্থ এক নারীর শরীর থেকে চামড়া নিয়েছিলেন, যিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিলেন। অবশ্য কেন মানুষের চামড়া দিয়ে বই বাঁধাইয়ের মতো উদ্ভট কাজটি করেছিলেন ওই ব্যাখ্যাও বইয়ের ভেতর একটি চিরকুটে দিয়ে গিয়েছিলেন ডা. বোল্যান্ড। চিরকুটে ওই চিকিৎসক লিখেছিলেন, ‘মানব আত্মা নিয়ে লেখা একটি বই অবশ্যই মানুষের চামড়া দিয়ে বাঁধাই হওয়ার দাবি রাখে।’
বইটির বাঁধাই অপসারণ করা হয়েছে উল্লেখ করে হার্ভার্ড বলেছে, ‘বইটির তদারককারীদের অতীতের ব্যর্থতা, যা মানুষের মর্যাদাকে আরও আপত্তিকর এবং যার দেহাবশেষ বাঁধাইয়ের জন্য ব্যবহৃত হয়েছিল তাকে হেয় করেছে।’
অজ্ঞাত ওই নারীর এই দেহাবশেষের সম্মানজনক সৎকারের পাশাপাশি এখন ওই নারীর জীবন নিয়েও গবেষণা চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে হাফটন লাইব্রেরি।
ইংরেজ গ্রন্থ বিশেষজ্ঞ এডওয়ার্ড ব্রুক-হিচিং তার ‘দ্য ম্যাডম্যান’স লাইব্রেরি’ গ্রন্থে এই প্রসঙ্গে মুখ খুলতে গিয়ে প্রথমেই যে প্রশ্নটি তুলেছেন তা হলো- এত কিছুর চামড়া থাকতে কেন মানুষের চামড়া দরকার পড়ল এসব বইয়ের বাঁধাইকর্মে? আরও বিস্ময়ের ব্যাপার, এসব বাঁধাইকর্ম কিন্তু সংঘটিত হয়েছিল ১৮ এবং ১৯ শতকের ইউরোপে। অর্থাৎ যে সময়ে যুক্তিবাদের প্রবল বন্যা এসে ভাসিয়ে দিচ্ছে যাবতীয় কুসংস্কার আর উদ্ভট প্রথা, সেই সময় মানুষের চামড়া দিয়ে বাঁধানো হয়েছিল এসব বই।
ব্রুক-হিচিং জানাচ্ছেন, ইউরোপ এবং আমেরিকায় সেই সময় মানুষের চামড়া দিয়ে বাঁধানো হতে থাকে প্রধানত দুই ধরনের বই। এক. বিভিন্ন অপরাধের ‘কেস স্টাডি’ এবং দুই. চিকিৎসাবিদ্যা সংক্রান্ত বইপত্র।
১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের সময় গুজব রটে যে, প্যারিসের উপকণ্ঠে মিউডন শহরে মানুষের চামড়কে বই বাঁধানোর উপযোগী করে তোলার জন্য এক ট্যানারি বানানো হয়েছে। সম্ভবত বিপ্লবের ভয়াবহতা থেকেই এমন গুজবের জন্ম হয়েছিল।
এই মুহূর্তে বিশ্বে মানুষের চামড়ায় বাঁধানো যে কটি বইয়ের সন্ধান পাওয়া গেছে, তার মধ্যে অন্যতম ইংল্যান্ডের ব্রিস্টলের প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত খুনের আসামি জন হরউডের চামড়ায় বাঁধানো একটি বই। এই বইয়ে বর্ণিত হয়েছিল হরউডের অপরাধ, বিচার এবং মৃত্যুদণ্ডের বর্ণনা।
১৮২৮ সালে স্কটল্যান্ডের এডিনবরায় ১৬টি ধারাবাহিক হত্যাকাণ্ড ঘটে। তদন্তে ধরা পড়ে, এই খুনগুলো করেছিলেন উইলিয়াম বার্ক এবং উইলিয়াম হেয়ার নামের দুই ব্যক্তি। তারা মরদেহগুলো রবার্ট নক্স নামের এক শরীরবিদ্যা বিশেষজ্ঞের কাছে বিক্রি করেন। নক্স সেগুলো তার পরীক্ষায় ব্যবহার করতেন।
১৮২৯ সালে বার্কের ফাঁসি হয়। তার চামড়া দিয়ে একটি বই বাঁধানো হয়। বার্কের ‘ডেথ মাস্ক’ এবং সেই বই রক্ষিত আছে এডিনবরার সার্জন’স হল মিউজিয়ামে।
১৮৬৩ সালে বাঁধানো এক বইয়ের নাম ‘ডি হিউম্যানি কর্পোরিস ফ্যাব্রিকা’। এর লেখক আন্দ্রে ভেসালিয়াস নামে ১৬ শতকের এক চিকিৎসক। তাকে আধুনিক শরীরবিদ্যা চর্চার জনক হিসেবে গণ্য করা হয়। সেই গ্রন্থের একটি কপি মানুষের চামড়া দিয়ে বাঁধান হোসে শাভায়ে নামে এক বাঁধাইকর। কথিত, শাভায়ে নাকি সারা জীবনে মানব ত্বক ব্যবহার করে চারটি বই বাঁধিয়েছিলেন।
১৯০৩ সালে নিউইয়র্কের গ্রোলিয়ের ক্লাবে বই বাঁধাই সংক্রান্ত এক প্রদর্শনী আয়োজিত হয়। তার একটি অংশে রাখা হয় উদ্ভট কিছু বই। সেখানে জার্মান চিত্রকর হোলবাইনের বিখ্যাত ছাপাই ছবির সিরিজ ‘ডান্স অব ডেথ’-এর একটি সংকলন গ্রন্থ। ১৯ শতকে বাঁধানো এই বইটিতেও ব্যবহৃত হয়েছিল মানুষের চামড়া।
শিকাগোর নিউবেরি লাইব্রেরিতে ১৮৪৮ সালের একটি আরবি পাণ্ডুলিপি রক্ষিত আছে। তার সঙ্গে একটি ‘নোট’ পাওয়া গিয়েছিল যাতে বলা ছিল যে, পাণ্ডুলিপিটি মানুষের চামড়ায় বাঁধানো। এই পাণ্ডুলিপিটির কথা আমেরিকান লেখক অড্রে নিফেনেগ্গার তার জনপ্রিয় উপন্যাস ‘দ্য টাইম ট্রাভেলার্স ওয়াইফ’ (২০০৩)-এ উল্লেখ করেছেন। প্রসঙ্গত, এই উপন্যাসের পটভূমিকা নিউবেরি।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগ্রহে তিনটি এমন বই রয়েছে বলে জনশ্রুতি ছিল। পরে বিশেষজ্ঞরা সেগুলো পরীক্ষা করে দেখতে পান, তার মধ্যে দুটি ভেড়ার চামড়ায় বাঁধানো। আর একটি বই লুডোভিক বোল্যান্ডের বাঁধানো সেই গ্রন্থ।
মানব ত্বকে বাঁধানো বই তাদের ছায়া ফেলেছে সাহিত্য-সংস্কৃতির জগতেও। আমেরিকান সাহিত্যিক এইচপি লাভক্র্যাফটের (১৮৯০-১৯৩৭) ‘দ্য হাউন্ড’ গল্পে এক কবর-চোরের সংগ্রহে থাকা এমন একটি বইয়ের উল্লেখ আছে।
লাভক্র্যাফটের গল্পে সেই চোর দাবি করছে, সে মানুষের চামড়ায় বাঁধানো একটি পোর্টফোলিও হস্তগত করেছিল যেখানে বেশ কিছু উদ্ভট ছবি ছিল। চোরের দাবি, সেই ছবিগুলো নাকি স্পেনীয় চিত্রকর ফ্রান্সেস্কো গোইয়ার (১৭৪৬-১৮২৮) আঁকা। কিন্তু গোইয়া কখনো তা স্বীকার করেননি। প্রসঙ্গত, তথাকথিত ভয়ের ছবি আঁকার জন্য গোইয়ার খ্যাতি ছিল।
আমেরিকান হরর ছায়াছবি ফ্র্যাঞ্চাইজি ‘ইভিল ডেড’-এ বেশ কয়েকবার ব্যবহৃত উত্থাপিত হয়েছে ‘নেক্রোনমিকন এক্স-মর্টিস’ নামের একটি বইয়ের প্রসঙ্গ। সেই বই যে শুধু মানুষের ত্বকে বাঁধানো তা-ই নয়। তা নাকি মানুষের রক্তে লিখিত। প্রসঙ্গত, ‘নেক্রোনমিকন’ লাভক্র্যাফটের বিভিন্ন রচনায় উল্লেখিত একটি কল্পিত বই, যা নাকি সুমেরিয়ার এক কালো-জাদুকরের লেখা।
আজকাল মানুষের চামড়া দিয়ে বই মলাট করাকে উদ্ভট বা ঘৃণ্য কাজ হিসেবে গণ্য করা হলেও এক সময় অবশ্য এর প্রচলন ছিল। বোল্যান্ড লিখেছিলেন, ‘‘ষোড়শ শতাব্দী থেকে ‘এনথ্রোপোডার্মিক’ শব্দটি বেশ প্রচলিত, যার অর্থ হচ্ছে মানুষের চামড়া দিয়ে বইয়ের মলাট করা। ওই শতকে এর প্রচলন ছিল।’’
তখন কেউ অপরাধ করলে তার চামড়ায় তা লিখে দেওয়া হতো। অনেক সময় কেউ কেউ মরে যাওয়ার পর তার চামড়া দিয়ে বইয়ের মলাট বানিয়ে তাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের অনুরোধও করে যেতেন। ইন্টারনেট অবলম্বনে