ডেস্ক অনুবাদ
Thank you for reading this post, don't forget to subscribe!ভারতবর্ষের সর্বোচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তিদের তালিকা করলে যার নাম সর্বাগ্রে থাকে তিনি হলেন মারাঠা বংশোদ্ভূত শ্রীকান্ত জিচকার। ছোটবেলা থেকেই শ্রীকান্তের পড়াশোনার প্রতি প্রবল আগ্রহ, জ্ঞানার্জনের প্রতি এক ধরনের তীব্র ঝোঁক ছিল। যা পরবর্তীতে শ্রীকান্ত জিচকারকে জ্ঞানার্জনের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকতে সাহায্য করেছে। শ্রীকান্ত জিচকারের পথচলা শুরু হয় চিকিৎসাবিজ্ঞান দিয়ে। শ্রীকান্ত জিচকার ছিলেন একজন সত্যিকারের জ্ঞানপিপাসু। একে একে জ্ঞানবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ থেকে কঠোর অধ্যবাসয়ের মাধ্যমে নাগপুরের এক মেডিকেল কলেজ থেকে প্রথমে ‘এমবিবিএস’ পরে ‘এমএস’ ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি একজন খ্যাতনামা চিকিৎসক হয়েও চিকিৎসা পেশায় বেশি দিন স্থায়ী হতে পারেননি।
শ্রীকান্ত জিচকার সবসময় জ্ঞানের নতুন নতুন দ্বার উন্মোচনের অপেক্ষায় থাকতেন। চিকিৎসা পেশা থেকে হঠাৎ করেই আইনজীবী হওয়ার তীব্র ইচ্ছা জাগে শ্রীকান্তের। ওকালতি করার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে তিনি ‘এলএলবি’ ডিগ্রি সম্পন্ন করে ‘ইন্টারন্যাশনাল ল’-এর ওপর স্নাতকোত্তর ডিগ্রিও অর্জন করেন। পর্যায়ক্রমে ‘বিজনেস ম্যানেজমেন্ট’-এর ওপর প্রথমে ডিপ্লোমা এবং পরবর্তীতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি সম্পন্ন করেন।
শ্রীকান্ত জিচকার এমন এক ব্যক্তিত্ব যাকে তার লক্ষ্যবস্তু থেকে কোনো কিছুই বিন্দুমাত্রও টলাতে পারেনি। যখনই পড়াশোনায় একটু একঘেয়েমি চলে আসত তখনই তিনি ভিন্ন আঙ্গিকে পড়াশোনা চালিয়ে গেছেন কিন্তু দমে যাননি। তিনি জীবনে যা চেয়েছেন তা না পাওয়া পর্যন্ত একটুও পিছপা হননি।
শ্রীকান্ত জিচকার ভারতের ৪২টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে ২০টিতেই উত্তীর্ণ হন। শুনতে কিছুটা অবিশ্বাস্য মনে হলেও এটাই সত্যি যে, শ্রীকান্ত জিচকার অর্থনীতি, ভারতীয় ইতিহাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, দর্শন, সমাজবিজ্ঞান, ইংরেজি সাহিত্য, জনব্যবস্থাপনা ও সংস্কৃতিসহ দশ-দশটি বিষয়ের ওপর স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছেন। যে ডিগ্রিগুলো অর্জন করতে মানুষ জীবনভর পরিশ্রম করেও সহজে নিজের করতে হিমশিম খায় সেই উচ্চশিক্ষার ধাপগুলো শ্রীকান্ত যেন লাফিয়ে লাফিয়ে পার করেছেন। আরও আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, মাত্র ২৪ বছর বয়সেই তিনি এই স্বপ্নগুলো বাস্তবায়নে সক্ষম হয়েছেন।
তিনি ১৯৭৩ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত প্রতি গ্রীষ্ম ও শীতে কোনো না কোনো বিষয়ের ওপর স্নাতকোত্তর পরীক্ষা দিয়েছেন এবং বেশির ভাগ পরীক্ষাতেই সফলতার সঙ্গে এমনকি প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছেন। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাগুলোয় ঈর্ষান্বিত ফলাফল অর্জন করায় একের পর এক স্বর্ণপদকও পেয়েছেন এই ভদ্রলোক। জিচকারের অর্জনের ঝুলিতে রয়েছে মোট ২৮টি স্বর্ণপদক। জ্ঞানের প্রতি গভীর অনুরাগ, প্রবল তৃষ্ণা শ্রীকান্ত জিচকারকে এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে। শ্রীকান্ত যখন ২৫ বছরের টগবগে যুবক তখন তার মাথায় IPS হওয়ার ভূত চাপে। IPS-এর প্রস্তুতি গ্রহণ শেষে পরীক্ষায় পাস করে কিছুদিন পর ১৯৮০ সালে IAS অফিসার হিসেবেও নিজেকে আবিষ্কার করেন। ভারতবর্ষে তখনো UPSC পরীক্ষা চালু না হওয়ায় IAS ও IPS চাকরির জন্য আলাদা এক্সাম হতো। মাত্র চার মাস চাকরি করার পর পদত্যাগ করে ঝুঁকে পড়েন রাজনীতিতে।
১৯৮০ সালে তুখোড় মেধাবী ‘ইন্ডিয়ান অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস’ থেকে পদত্যাগ করে মাত্র ২৬ বছর বয়সে যোগ দেন রাজ্যসভার সর্বকনিষ্ঠ এমএলএ হিসেবে। সংসদ সদস্য হয়েছেন মন্ত্রী হবেন না, তা কী করে হয়। পর্যায়ক্রমে তিনি সরকারের মন্ত্রি পর্যায়ের একজন প্রভাবশালী মন্ত্রি হিসেবে মনোনীত হন। তিনি রাজ্যের মন্ত্রী, রাজ্যসভার সদস্য এবং মহারাষ্ট্র আইন পরিষদের সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। শ্রীকান্ত জিচকার প্রতিটি পেশায় নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়েছিলেন। তিনি একাধারে ১৪টি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন।
এ পৃথিবীতে সবাই নিয়মের বেড়াজালে আটকা পড়লেও শ্রীকান্ত জিচকার যেন এসব নিয়মের তোয়াক্কা করেননি। তিনি একাধারে ডাক্তার, আইনজীবী, IAS অফিসার, চিত্রকর, পেশাদার ফটোগ্রাফার, রাজনীতিবিদ, মঞ্চ অভিনেতা, সাংবাদিক, জ্যোতিষ শাস্ত্রের একজন মহান পণ্ডিত ছিলেন। এ ছাড়া শ্রীকান্ত জিচকার ধর্মীয় বিষয়েও যথেষ্ট পাণ্ডিত্য অর্জন করেছিলেন। সংস্কৃতের ওপর তিনি ডক্টর অব লিটারেচার (পিএইচডি) ডিগ্রি লাভ করেন।
ভারতের নাগপুরের আজনগাঁওয়ের এক মারাঠা পরিবারে জন্ম নেওয়া শ্রীকান্ত জিচকার ছিলেন প্রচণ্ড জ্ঞানপিপাসু। পৃথিবীতে অর্থবৃত্ত, ক্ষমতা ও পেশিশক্তি প্রদর্শন তো অনেকেই করে থাকে কিন্তু বিদ্যার এমন প্রভাব, প্রতিপত্তি, নজির কজনই-বা দেখাতে পারে?
ভারতে তার একক ব্যক্তিগত পাঠাগারেই ৫২ হাজারেরও বেশি পুস্তক সংগৃহীত ছিল। ক্ষণজন্মা এই ভদ্রলোকের জ্ঞানের প্রতি তৃষ্ণার কিছুটা প্রমাণ মেলে তার ব্যক্তিগত পাঠাগারের মস্ত সংগ্রহশালা থেকেই। তার ব্যক্তিগত গ্রন্থাগারটি ভারতের বৃহত্তম ব্যক্তিগত গ্রন্থাকার হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। শ্রীকান্ত জিচকারের মাত্র ২৫ বছর বয়সেই ১৪টি পোর্টফোলিও ছিল। ধর্ম, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা বিষয়ে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য ডাক্তার জিচকার বহু দেশ ভ্রমণ করেছেন। ক্ষণজন্মা এই ভারতীয় বংশোদ্ভূত ইউনেস্কো ও সম্মিলিত জাতিপুঞ্জে ভারতের প্রতিনিধিত্বও করেছেন। ভারতের রেকর্ড বুক ‘লিমকা বুক অব রেকর্ডস’ শ্রীকান্ত জিচকারকে ভারতের সবচেয়ে শিক্ষিত ব্যক্তি হিসেবে পরিগণিত করে।
শ্রীকান্ত জিচকার শুধু যে নিজেই জ্ঞানার্জনের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন বিষয়টি তা নয় বরং তিনি শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারেও কাজ করেছেন। তিনি বাচ্চাদের মধ্যে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিতে, আলোকিত সমাজ গঠনে এবং জ্ঞানবিজ্ঞানের প্রচার প্রসারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। ১৯৯২ সালে নাগপুরে সন্দীপনী স্কুল ও সমৃদ্ধ একটা গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে শিক্ষার নতুন দ্বার উন্মোচন করেন।
২০০৪ সালের ২ জুন নাগপুর থেকে প্রায় ৪০ কি.মি দূরে এক সড়ক দুর্ঘটনায় মাত্র ৫১ বছর বয়সে এই ক্ষণজন্মা গুণিজন পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন।