ডেস্ক রিপোর্ট
اللهُ يَبْسُطُ الرِّزْقَ لِمَنْ تَشَاءُ وَيَقْدِرُ ط وَفَرِحُوا بِالْحَمُرِةِ الدُّنْبَاءِ وَمَا الْحَيوة الدُّنْيَا فِي الْآخِرَةِ الأَمَتَاعُ المرور.
আল্লাহ যাকে চান রিযিকের প্রাচুর্য দান করেন আর যাকে চান পরিমিত পরিমাণ রিযিক দেন। এ লোকেরা দুনিয়ার জীবনে আনন্দে নিমগ্ন হয়ে থাকে অথচ দুনিয়ার জীবন পরকালের তুলনায় সামান্য পরিমাণ সামগ্রী ছাড়া কিছুই নয়। (সূরা রা’দ : ২৬)
শব্দের অর্থ
“রিযক’ শব্দের ব্যাপক অর্থ সূরা বাকারার ৩ নম্বর আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে।
তাফসীরভিত্তিক আলোচনা
মাওলানা আবুল আ’লা মওদূদী এ আয়াতের তাফসীরে লিখেছেন : এ আয়াতের পটভূমি এই যে, মূসার কাফিরগণও সাধারণ মূর্খদের ন্যায় আকীদা ও আমলের ভালো-মন্দ দেখার পরিবর্তে ধনী ও দরিদ্র হওয়ার দৃষ্টিতে মানুষের মূল্য ও মর্যাদা নির্ধারণ করত। তাদের ধারণা ছিল, যে লোক দুনিয়ার আরাম-আয়েশের দ্রব্যসামগ্রীর অধিকারী, সে লোক বুঝি আল্লাহরও প্রিয় কার্যত সে যতই পথভ্রষ্ট ও অনাচারী হোক না কেন। পক্ষান্তরে যার অবস্থা দীন-দরিদ্র সে আল্লাহরও অপ্রিয়, অভিশপ্ত লোক, তার আমল, আখলাক, যতই উন্নত ও পবিত্র হোক না কেন। এ কারণেই তারা কুরাইশ সম্প্রদায়কে নবী করীম (স)-এর সাহাবীদের তুলনায় অনেক মর্যাদাবান ও সম্মানী মনে করত। তারা বলত, ‘এই দেখই না, আল্লাহ্ কাদের সঙ্গে রয়েছেন।’ এ সম্পর্কে আল্লাহ সাবধান করে দিয়েছেন। বলেছেন, রিযিকের কম বেশী হওয়া তো আল্লাহর অপর এক নিয়মের অধীন। অপর দিক দিয়ে অসংখ্য রকমের বিবেচনার ভিত্তিতে আল্লাহ তা’আলা কাউকে বেশী, , কাউকে কম দান করেন। কিন্তু মানুষের অভ্যন্তরীণ নৈতিক মানদণ্ডের জন্য এটা কোনো মানদণ্ড নয়। মানুষের মধ্যে মর্যাদার পার্থক্যকরণের আসল ভিত্তি এবং সৌভাগ্যবান ও দুর্ভাগ্যশালী হওয়ার আসল মাপকাঠি হচ্ছে যে চিন্তা ও কর্মের সঠিক পন্থা কে গ্রহণ করেছে, কে উত্তম গুণাবলীর অধিকারী হয়েছে আর কে খারাপ গুণাবলীর। কিন্তু অজ্ঞ-মূর্খ লোকেরা এ ভিত্তি ও মাপকাঠি বাদ দিয়ে কাকে ধন-সম্পদ বেশী দেয়া হয়েছে আর কাকে কম- তারই ভিত্তিতে বিচার করে থাকে।
আল্লামা শাব্বীর আহমদ উসমানী লিখেছেন : পৃথিবীতে বেশী সম্পদ ও অর্থ হওয়া ভালো ভাগ্য বা মন্দ ভাগ্যের ব্যাপার নির্ধারণ করে না। এটা সব সময় সত্য নয় যে, যাদের বেশী ধন-সম্পদ আছে তারা আল্লাহর অধিক প্রিয়। আল্লাহর অনেক* প্রিয় বান্দা দারিদ্র্যে জীবন কাটায়, অন্যদিকে অনেক অপরাধী লোক আরাম- আয়েশে দুনিয়ায় থাকে। এটিই আখিরাত সংগঠন করার কারণ। সুনিশ্চিতভাবে আর একটি জগত আছে যেখানে ভালো- মন্দ কাজের ফল পাওয়া যাবে। সংক্ষেপে পৃথিবীর অভাব বা প্রাচুর্য গ্রহণ বর্জনের মানদণ্ড হতে পারে না।
আর্থ সামাজিক তাৎপর্য
সূরা রা’দ রাসূলুল্লাহ (স)-র মক্কী জীবনের শেষ পর্যায়ে অবতীর্ণ হয়। এই সূরায় নানাভাবে তাওহীদ, পরকাল ও নবুওত-রিসালাতের সত্যতার প্রমাণ পেশ করা হয়েছে। এই সূরার ৩য় রুকূতে সৎ ও মন্দ লোকদের গুণাবলী আলোচনা করা হয়েছে। সৎ লোকদের গুণাবলী পর্যায়ে বলা হয়েছে- তারা আল্লাহর সঙ্গে কৃত ওয়াদা পূরণ করে, আল্লাহ যে সব সম্পর্ক বহাল রাখতে বলেছেন তা বহাল রাখে, ধৈর্য ধারণ করে, নামায কায়েম করে, আল্লাহর দেয়া রিযিক হতে প্রকাশ্য ও গোপনে খরচ করে এবং অন্যায়কে ন্যায় দ্বারা প্রতিরোধ করে। এই সব লোকের জন্য রয়েছে পরকালে বিশেষভাবে পুরস্কার। সৎ লোক দুনিয়াতে পুরস্কার পেতে পারে আবার নাও পেতে পারে। আল্লাহর নানা নিয়মে তা ঘটতে পারে। যেমন আল্লাহ পাক সূরা বাকারায় বলেছেন :
আমি তোমাদেরকে ভয়, ক্ষুধা এবং ধন-সম্পদ, জীবন ও ফল-ফসলের ক্ষতি দ্বারা পরীক্ষা করব। তুমি শুভ সংবাদ দাও ধৈর্যশীলদিগকে। (সূরা বাকারা : ১৫৫ )
দুনিয়াতে কোনো সৎ লোকের কম ধন-সম্পদ হওয়া তার আল্লাহর নিকট অপ্রিয় হওয়ার লক্ষণ নয়। তেমনিভাবে কারো বেশী ধন-সম্পদ হওয়া আল্লাহর নিকট প্রিয় হওয়ার লক্ষণ নয়- যেমন মক্কার কাফিররা বিশ্বাস করত। আজ-কালও পাশ্চাত্যের উন্নত জৌলুসে প্রভাবিত লোকেরা এ ধারণা বিশ্বাস ও প্রচার করে থাকে। এ বিশ্বাস ও যুক্তির অসারতা ঘোষণা করেই আল্লাহ পাক বলছেন যে, তিনি যাকে ইচ্ছা রিযিকের প্রাচুর্য দান করেন আর যাকে ইচ্ছা রিযিক কম দেন। এসব ঘটে থাকে আল্লাহর পরিকল্পনা ও নৈতিক আইনের অধীনে।
অবশ্য এখানে এ কথাও উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, রিযিক অর্জন ও ধন বণ্টন সম্পর্কিত আল্লাহর আইনের অন্যান্য দিকও রয়েছে। যেমন প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার রিযিকের জন্য চেষ্টা করতে হবে। (সূরা জুমু’আ : ১০; সূরা নিসা : ৩২; সূরা হাশর : ৭)। তেমনিভাবে অভাবগ্রস্ত ব্যক্তিকে সমাজ ও রাষ্ট্র দেখাশুনা করবে এবং তার অভাব দূর করবে। (সূরা তওবা : ৬০; সূরা জারিয়াত)
আলোচ্য আয়াতে ধন বন্টন সম্পর্কিত আল্লাহর একটি মৌলিক নীতি সুস্পষ্ট হয়। ইসলামের ধন বণ্টন নীতি সম্পর্কিত অন্যান্য শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে এ আয়াতের বক্তব্যকেও ইসলামী অর্থ ও সমাজনীতিদের মনে রাখতে হবে।
অর্থাৎ এ আয়াত থেকে একথা মোটেই বোঝায় না যে, সম্পদে মানুষের হিস্যার বিষয়টি আল্লাহ তা’আলা নির্ধারণ করে থাকেন বলে তাকে সম্পদ অর্জনের জন্য কোনো চেষ্টা তদবির করতে হবে না। কেননা এখানে উল্লিখিত বিষয়টি হলো প্রাকৃতিক ও নৈতিক পরিকল্পনার অন্তর্গত আর সম্পদ অর্জনের জন্য চেষ্টা করা সাধারণ নীতিমালার অন্তর্গত। এ দু’য়ের সমন্বয়েই ইসলামী জীবন দর্শন পূর্ণাঙ্গ রূপ লাভ করে এবং এতেই ইসলামের সৌন্দর্য ও বৈশিষ্ট্য নিহিত।