তানভীর আল মাহমুদ
Thank you for reading this post, don't forget to subscribe!এই নশ্বর পৃথিবী একটি নির্দিষ্ট গতিময়তার মধ্য দিয়ে যায়। ভোরে সূর্য দীপ্যমান ফোয়ারায় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে রাতের অন্ধকারকে দূরীভূত করে পৃথিবীব্যাপী তার স্নিগ্ধ কোমল আভার আবরণ বিছিয়ে দেয়। ধীরে ধীরে তার তাপপ্রবাহ প্রখর হয়, পৃথিবীকে করে তোলে তপ্ত, উত্তপ্ত। এরপর তার তাপপ্রবাহ কমতে থাকে; একসময় তার আলো নিষ্প্রভ হয়ে যায়। পৃথিবীজুড়ে নেমে আসে ঘুটঘুটে কালো অন্ধকার। এভাবে দিন গিয়ে রাত নামে। রাত গিয়ে দিন আসে।
রাত-দিনের এই চলমান প্রক্রিয়ায় প্রকৃতি তার রূপের পরিবর্তন করে থাকে। পরিবর্তনটা কখনো হয় ধীরে ধীরে ; কখনো আবার আকস্মিক। প্রকৃতির রূপ ও সৌন্দর্য যেমন মুগ্ধকর তেমনি এর হিংস্রতাও বেশ ভয়ঙ্কর। যখন প্রকৃতির ভয়ঙ্কর রূপ ও হিংস্রতা জনজীবনকে স্থবির ও অস্থির করে তুলে তখন তাকে বলা হয় প্রাকৃতিক দুর্যোগ।
এই প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণ ও উৎসকে বিভিন্ন জন বিভিন্ন ভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। কেউ এটাকে প্রকৃতির নিত্যনৈমিত্তিক অন্যসব সাধারণ কোনো ঘটনার মতো দেখেন। আবার অনেকে জনজীবনের বৈষয়িক কাজকর্মের প্রভাবে প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হওয়াকে এর উৎস বলে বিবেচনা করেন।
কিন্তু ইসলাম ও বাস্তবতা বলে ভিন্ন কিছু। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘মানুষের কৃতকর্মের দরুন স্থলে ও সাগরে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে, ফলে তিনি তাদের কোনো কোনো কাজের শাস্তি আস্বাদন করান, যাতে তারা ফিরে আসে। ’ (সূরা রোম, আয়াত-৪১)অর্থাৎ পৃথিবীর তাবৎ বিপর্যয় ও দুর্যোগ যেমন- দুর্ভিক্ষ, মহামারী, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, খরা, অগ্নিকাণ্ড, পানিতে নিমজ্জিত হওয়ার ঘটনাবলির প্রাচুর্য, সব কিছু থেকে বরকত উঠে যাওয়া, উপকারী বস্তুর উপকার কম এবং ক্ষতি বেশি হয়ে যাওয়া ইত্যাদি সব কিছু মানুষের কৃতকর্মের ফল।
আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘গুরু শাস্তির আগে আমি অবশ্যই তাদেরকে লঘু শাস্তি আস্বাদন করাব, যাতে তারা প্রত্যাবর্তন করে।’ (সূরা সাজদা-২১) এ আয়াতের তাফসিরে হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা: বলেন, ‘ছোট শাস্তি হলো দুনিয়ার বিপদাপদ, রোগব্যাধি, মৃত্যু এবং তাদের ওপর নেমে আসা অন্যান্য মুসিবত, যা দিয়ে আল্লাহ তার বান্দাকে পরীক্ষা করেন, যাতে বান্দা আল্লাহর দিকে ফিরে আসে।’
‘আমি তোমাদের ভয় ও ক্ষুধা দিয়ে, সম্পদ, প্রাণ ও ফসলের হানি করে পরীক্ষা করব। আর ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দিন, যাদের ওপর বিপদ এলে তারা বলে, আমরা আল্লাহর জন্যই, আমরা তার দিকেই ফিরে যাব। তাদের ওপর তাদের রবের ক্ষমা ও রহমত অবতীর্ণ হয়। আর তারাই সঠিক পথপ্রাপ্ত।’ (সূরা বাকারা : ১৫৫-১৫৭)
বন্যা বাংলাদেশের একটা উল্লেখযোগ্য দুর্যোগ। প্রতি বছর এই বন্যায় প্রচুর পরিমাণে আর্থসামাজিক ক্ষতি ও প্রাণহানি ঘটে। ইতঃপূর্বে সিলেটে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা হয়েছে। প্রচুর পরিমাণের আর্থসামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতি সাধিত হয়েছে। গত একদিন আগে “রেমাল” ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে অনেক এলাকা বিশেষ করে উপকূলীয় অঞ্চল পানিতে টইটম্বুর হয়ে গেছে, অনেকের মৃত্যুর খবর পাওয়া যাচ্ছে, অনেক মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় দিনাতিপাত করছে। এছাড়াও অনেক প্রাণী ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
বন্যা সম্পর্কে কুরআনে বর্ণিত হয়েছে- নুহ আ: তাদের আল্লাহর সাথে নাফরমানি ও তাঁর সাথে অন্য কিছুকে শরিক করার শাস্তি সম্পর্কে সতর্ক করেছিলেন। তবু তাদের চৈতন্যোদয় হয়নি। অবশেষে আল্লাহর আজাব আসে। এক ভয়ঙ্কর প্লাবন, বন্যা ও জলোচ্ছ্বাস তাঁর জাতির অবাধ্য লোকদের ভাসিয়ে নিয়ে যায়। এমন বন্যা সেই জাতিকে গ্রাস করেছিল, যেই বন্যা হাজার বছর ধরে পৃথিবীতে ইতিহাস হয়ে আছে। তখন নুহ আ:-এর নৌকায় যারা আশ্রয় নিয়েছিল তারাই রক্ষা পেয়েছিল। আল্লাহ বলেন, ‘আমি তার (নুহের) বংশধরদের অবশিষ্ট রেখেছি বংশপরম্পরায়’। (সূরা আস সাফফাত-৭৭)
ভূমিকম্প জনজীবনের এক আতঙ্কের নাম। অন্যান্য দুর্যোগগুলোর আগমনের কিছু স্পষ্ট ও অস্পষ্ট পূর্বাভাস দেখা দিলেও ভূমিকম্পের কোনো পূর্বাভাস দেখা মেলে না। এটি হঠাৎ এসে মুহূর্তেই সব কিছু তছনছ করে চলে যায়। ভূমিকম্প সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, ‘বলে দাও, আল্লাহ তোমাদের ওপর থেকে অথবা তোমাদের পায়ের নিচ থেকে আজাব পাঠাতে সক্ষম। ’ (সূরা আনআম-৬৫) মুফাসসিরদের মতে এর ব্যাখ্যা হলো ভূমিকম্প।
বাংলাদেশে খরা একটি জলবায়ুগত মৌলিক সমস্যা। বিশেষ করে বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল ও উত্তরাঞ্চলে এলাকাগুলো এই সমস্যায় জর্জরিত। আল্লাহর নাফরমানির কারণে কখনো কখনো খরা দেখা দেয়। পবিত্র কুরআনে এই দুর্যোগ থেকে উত্তরণের পন্থা বর্ণিত হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘অতঃপর বলেছি, তোমাদের রবের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো, নিশ্চয় তিনি মহাক্ষমাশীল, তিনি তোমাদের জন্য প্রচুর বৃষ্টিপাত করবেন…। ’ (সূরা নুহ : ১০-১১) আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- রাসূল সা: ইরশাদ করেন, ‘তোমাদের প্রবল পরাক্রমশালী প্রভু বলেছেন, যদি আমার বান্দারা আমার বিধান মেনে চলত, তবে আমি তাদের রাতের বেলায় বৃষ্টি দিতাম, সকালবেলায় সূর্য দিতাম এবং কখনো তাদের বজ্রপাতের আওয়াজ শোনাতাম না।’ (মুসনাদে আহমদ-৮৭০৮)
প্রাকৃতিক দুর্যোগে মুমিনের করণীয় : দুর্যোগ আল্লাহর পক্ষ থেকে শাস্তিস্বরূপ ও মুমিনের জন্য সাবধানতা ও সতর্কতার বাণী। তাই সমস্ত দুর্যোগে আমাদেরকে আল্লাহর দিকে ফিরে আসতে হবে। তার নিকট একান্ত চিত্তে তওবা ও ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে। বিপদে ধৈর্য ও সহনশীলতার পাশাপাশি ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে তার থেকে সব বিপদ ও দুর্যোগ থেকে পরিত্রাণের জন্য প্রার্থনা করতে হবে।
রাসূল সা: প্রাকৃতিক দুর্যোগ সম্পর্কে খুবই শঙ্কিত ও সচেতন ছিলেন। তিনি সর্বদা দোয়া করতেন যেন তার উম্মতকে আকস্মিক দুর্যোগ দ্বারা ধ্বংস করা না হয়। ঝড়, বৃষ্টি, তুফানের সময় তিনি মসজিদে চলে যেতেন এবং তওবা ইস্তিগফার করতেন। চন্দ্রগ্রহণ ও সূর্যগ্রহণের সময় তিনি খাবার গ্রহণ করতেন না। তিনি আল্লাহর দরবারে লুটিয়ে পড়তেন এবং আসন্ন দুর্যোগ থেকে পরিত্রাণের জন্য দোয়া করতেন।
মুমিনের উচিত আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করা এবং তার অবাধ্যতা থেকে নিজেকে এবং সমাজকে মুক্ত রাখা। তবেই আল্লাহ তায়ালা পার্থিব জীবনের কঠিন বিপদাপদ ও দুর্যোগ থেকে মুক্তি দেবেন এবং মৃত্যুর পরে উত্তম প্রতিদান দেবেন। আল্লাহ বলেন, ‘যে আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তার জন্য পথ (কল্যাণের ফয়সালা) তৈরি করে দেন। (সূরা তালাক-২)
প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে অনেক মানুষ গৃহহীন ও সম্বলহীন হয়ে পড়ে। অনেকে তাদের সর্বস্ব খুইয়ে বসে। তাদেরকে মানবিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য করা মুমিনের ঈমানের দাবি ও নৈতিক দায়িত্ব। সুতরাং আমাদের উচিত সর্বাবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করা এবং তাঁর আনুগত্যপূর্বক সব বিধিবিধান মেনে নেয়া ও আমল করা।
️শিক্ষার্থী : ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।