ডেস্ক রিপোর্ট
আওয়ামী লীগ ধ্বংশের পেছনের কারণ পরিবারতন্ত্র। যা দলটির নেতাকর্মীদের ঢাকার একটি কলেজে শিক্ষকতা করতেন সাবেক জনপ্রশাসন মন্ত্রী ফরহাদ হোসেন। ২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন নিয়ে আসেন মেহেরপুরে। বিএনপিবিহীন ওই নির্বাচনে মেহেরপুর-১ (সদর-মুজিবনগর) আসনে জয়ী হয়ে পরের বছর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি পদ পেয়ে যান। এর পরপরই শুরু হয়েছে জেলা আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পদে স্ত্রী স্বজনদের পদায়ন।
Thank you for reading this post, don't forget to subscribe!মেহেরপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হওয়ার পর থেকে ফরহাদ হোসেনের স্ত্রীসহ অন্তত ১৭ স্বজন পেয়েছেন আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের বিভিন্ন পদ। ভগ্নিপতি আবদুস সামাদ বাবলু বিশ্বাস জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি, বোন শামীম আরা মহিলাবিষয়ক সম্পাদক, স্ত্রী সৈয়দ মোনালিসা ও চাচাতো ভাই আমিরুল ইসলাম সদস্য পদে আছেন। বড় ভাই ইকবাল হোসেন মেহেরপুর শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি। বাবার ফুফাতো ভাই সদ্য প্রয়াত বোরহান উদ্দিন ছিলেন সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। ফুফাতো ভাই মোমিনুল ইসলাম সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও বারাদি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান। ভাতিজা আদিব হোসেন মেহেরপুর সরকারি কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি ও ছোট ভাই সরফরাজ হোসেন জেলা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক পদে আছেন।
আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা বলছেন, পরিবারের সদস্য, স্বজন ও ঘনিষ্ঠজনদের দলীয় বিভিন্ন পদে বসিয়েছেন সাবেক জনপ্রশাসনমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন (দোদুল)। তাঁদের অনেককে জনপ্রতিনিধিও বানিয়েছেন। তাঁদের দিয়েই জেলার ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি। বিপরীতে কোণঠাসা করেছেন দলের ত্যাগী নেতাদের। তাঁর বিপক্ষে গেলে দলীয় নেতা-কর্মীদের নানাভাবে নির্যাতনের অভিযোগও রয়েছে। ফরহাদের ভাই ও ভগ্নিপতির দাপটে দলীয় নেতা-কর্মী ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা থাকতেন তটস্থ।
আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের সাত নেতা বলেন, ফরহাদের আধিপত্যের বিরোধিতা করা দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের নিষ্ক্রিয় করে রেখেছিলেন তিনি। এ নিয়ে দলের মধ্যে দুটি ধারা তৈরি হয়, যার অন্যপক্ষে নেতৃত্ব দিতেন সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি গোলাম রসুল। তাঁর সঙ্গে ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মিয়াজান আলী, সহসভাপতি ইয়ারুল ইসলাম, মুজিবনগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি জিয়াউদ্দিন বিশ্বাস, জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক মাহফুজুর রহমান প্রমুখ।
গোলাম রসুল বলেন, ফরহাদ হোসেন সৈয়দ আশরাফের চাচতো বোনকে বিয়ে করে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন। দশম সংসদ নির্বাচনে হঠাৎ তাঁর আর্বিভাব ঘটে মেহেরপুরের আওয়ামী রাজনীতিতে। এমপি বনে যাওয়ার পর আওয়ামী লীগকে পারিবারিক দল হিসেবে গড়ে তোলেন। প্রতিমন্ত্রী হওয়ার পর জেলা প্রশাসন ও পুলিশ বিভাগকে নিজের একক নিয়ন্ত্রণে নেন। ২০১৪ সাল থেকে জেলায় সরকারের যতগুলো উন্নয়নমূলক কাজ হয়েছে, এসব পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে তাঁর স্বজনেরা করেছেন।
দাপট দেখিয়েছেন ভাই-ভগ্নিপতি
বাবলু বিশ্বাস দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ফরহাদ হোসেনের পক্ষে এক সভায় প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী আবদুল মান্নানকে হুমকি দিয়ে বলেছিলেন, ‘কিসের ভয় দেখায়, আমি তো বুঝতি পারিনি। আমার চেয়ে মস্তান বেশি আছে কেউ? আমার চেয়ে যন্ত্রপাতি কারও বেশি আছে? আমার চেয়ে কি টাকা তাদের বেশি আছে? তাহলে ভয় কিসের দেখায়?’ একই সভায় তিনি বলেছিলেন, ‘পিরোজপুর ইউনিয়নের চারটি সেন্টারে (ভোটকেন্দ্রে) আমি যেন দেখতে না পাই কোনো এজেন্ট আছে ওই চাপা দেওয়া জিনিসের (ট্রাক প্রতীকের)।’
বাবলু বিশ্বাস সদর উপজেলার পিরোজপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। এলাকাবাসী বলেন, ফরহাদ হোসেনের ভগ্নিপতি হওয়ার সুবাদে এই ইউনিয়নে বাবলু বিশ্বাসের বিরুদ্ধে কারও কোনো কথা বলার সাহস ছিল না। ১০ বছর এই গ্রামের দাদ বিল তিনি দখলে রেখেছিলেন। ৫ আগস্টের পর স্থানীয় লোকজন বাবলু বিশ্বাসের বাড়িতে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করেন। এর পর থেকে তাঁরা পলাতক।
মেহেরপুর সরকারি বালিকা ও বালক উচ্চবিদ্যালয়ে দুটি ছয়তলাবিশিষ্ট একাডেমি ভবনের নির্মাণকাজ চলছে। প্রতিটি ভবন নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ছয় কোটি টাকা। বালিকা বিদ্যালয়ের ভবন নির্মাণের ঠিকাদার বাবলু বিশ্বাস, বালক বিদ্যালয়টির ঠিকাদার সরফরাজ হোসেন। পাশাপাশি অবস্থিত বিদ্যালয় দুটির শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকেদের অভিযোগ, তাঁরা বিদ্যালয়ের খেলার মাঠ দখল করে ভবন নির্মাণের সামগ্রী রেখেছিলেন। বালক বিদ্যালয়ের প্রধানশিক্ষক ফজলুল হক বলেন, ‘একাডেমি ভবন নির্মাণের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সদ্য সাবেক জনপ্রশাসনমন্ত্রী ফরহাদ হোসেনের ভগ্নিপতি আবদুস সামাদ বাবলু বিশ্বাস। তাঁকে মাঠ পরিষ্কার রাখতে নির্মাণসামগ্রী সরিয়ে নিতে বলার ক্ষমতা আমাদের ছিল না।’
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর গত ২৯ আগস্ট মেহেরপুর শহরের ক্যাশবপাড়ায় ফরহাদ হোসেনের ফুফাতো ভাই শাজাহান সিরাজের ভাড়া বাড়ি থেকে কোটি টাকা মূল্যের বিপুল পরিমাণ সরকারি মালামাল জব্দ করে যৌথ বাহিনী। ফরহাদ হোসেনের পক্ষে শাজাহান সিরাজ বাড়িটি ভাড়া নিয়েছিলেন। জব্দ মালামালের মধ্যে ছিল বিনা মূল্যে বিতরণের কোরআন শরিফ, কম্বল, বিভিন্ন ধরনের ক্রীড়াসামগ্রী, সেলাই মেশিন, হুইলচেয়ার, চিকিৎসকের অ্যাপ্রোন, পিপি, শাড়ি, লুঙ্গি, থ্রিপিস, অক্সিজেন সিলিন্ডার, শিক্ষার্থীদের টিফিন বক্স। এসব সামগ্রীর গায়ে লেখা রয়েছে ‘বিক্রয়ের জন্য নহে’।
জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি বাবলু বিশ্বাস সম্প্রতি মুঠোফোনে বলেন, ‘ফরহাদ হোসেন মন্ত্রী হওয়ার আগে থেকেই আমি ঠিকাদারি ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত আছি। ক্ষমতায় থাকলে অনেক অভিযোগ যুক্ত হয়। যারা অভিযোগ করে, তাদের হলফনামা ঘাটলে ব্যাপক দুর্নীতি পাওয়া যাবে।’