ডেস্ক রিপোর্ট
জুলাইয়ে দেশের সব বিশ্ববিদ্যাল সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের আন্দোলনে উত্তাল হয়ে ওঠে। যত দিন গড়ায় পরিস্থিতি ততই অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। কোটা আন্দোলে পুলিশ ও সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠনের হামলায় এ আন্দোলন গড়ায় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে। শেষপর্যায়ে এ আন্দোলন সরকার পতনের এক দফা দাবিতে গড়ায়। মধ্য জুলাইয়ে (১৫ জুলাই রাতে) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে মাঝরাতে স্লোগান উঠেছিল ‘আমি কে তুমি কে রাজাকার, রাজাকার/ কে বলেছে, কে বলেছে, স্বৈরাচার, স্বৈরাচার’।
স্লোগানকে বলা হয় আন্দোলনের ভাষা। সময়ের প্রয়োজনে, দাবির প্রয়োজনে মিছিল ও সমাবেশ থেকে স্লোগান জন্ম নেয়। হয়ে ওঠে আন্দোলনকারীদের দাবির প্রতীক। আবার সময়ের সঙ্গে সঙ্গে স্লোগান বদলেও যায়। নতুন আন্দোলন তৈরি করে নতুন স্লোগান, যুক্ত হয় পুরোনোর রেশ।
Thank you for reading this post, don't forget to subscribe!মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হলের স্লোগানটিও তেমন। এর আদি স্লোগান হলো—‘তুমি কে আমি কে/ বাঙালি বাঙালি’।
লেখক–গবেষক সিদ্দিকুর রহমান স্বপন তাঁর ‘বাংলাদেশের গণআন্দোলন: স্লোগান প্ল্যাকার্ড ও পোস্টার’ বইয়ে বলেছেন, ১৯৬৮ সালের শেষের দিকে তখনকার পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র সংগ্রাম কমিটির নেতৃত্বে ১১ দফার দাবি আদায়ে উত্তাল হয়ে উঠেছিল পূর্ব পাকিস্তান। আর ওই আন্দোলনে স্লোগান উঠেছিল ‘তুমি কে আমি কে, বাঙালি বাঙালি’। ওই সময় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের মিছিলে এই স্লোগান শোনা যেত।
লেখক–গবেষক সিদ্দিকুর রহমান স্বপন তাঁর ‘বাংলাদেশের গণআন্দোলন: স্লোগান প্ল্যাকার্ড ও পোস্টার’ বইয়ে বলেছেন, ১৯৬৮ সালের শেষের দিকে তখনকার পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র সংগ্রাম কমিটির নেতৃত্বে ১১ দফার দাবি আদায়ে উত্তাল হয়ে উঠেছিল পূর্ব পাকিস্তান। আর ওই আন্দোলনে স্লোগান উঠেছিল ‘তুমি কে আমি কে/ বাঙালি বাঙালি’। ওই সময় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের মিছিলে এই স্লোগান শোনা যেত।
স্লোগানটির সূচনার দুই প্রশ্নের আবেদন সাড়ে পাঁচ দশকের বেশি সময় পরে এসে একটুও কমেনি। বরং ক্ষোভ ও ব্যঙ্গের সুরে নতুন উত্তর নিয়ে ছাত্র–জনতার আন্দোলনের এক সন্ধিক্ষণে ফিরে এসেছিল।
১৯৬৯, ১৯৯০ আর ২০২৪ সালের তিনটি গণ–অভ্যুত্থানের আলোচিত স্লোগানগুলো একনজরে দেখে নেওয়া যাক—
১৯৬৯: আইয়ুববিরোধী
পাকিস্তানে তখন আইয়ুব খানের শাসন চলছে। বরাবরের শোষণ–বঞ্চনা, শেখ মুজিবসহ বাঙালি রাজনীতিবিদ, সামরিক কর্মকর্তা, সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে করা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাসহ নানা কারণে ফুঁসে উঠেছিল পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ। ছাত্র–জনতার ব্যাপক আন্দোলনে পতন ঘটেছিল এক দশকের আইয়ুবশাহির।
২০২৪ সালের ছাত্র–জনতার আন্দোলনে ‘চাইলাম অধিকার/ হয়ে গেলাম রাজাকার’; ‘আপস না সংগ্রাম/ সংগ্রাম সংগ্রাম’; ‘দালালি না রাজপথ/ রাজপথ রাজপথ’; ‘আমার সোনার বাংলায়/ বৈষম্যের ঠাঁই নাই’; ‘একাত্তরের হাতিয়ার/ গর্জে ওঠো আরেকবার’; ‘যে হাত গুলি করে/ সে হাত ভেঙে দাও’; ‘অ্যাকশন অ্যাকশন/ ডাইরেক্ট অ্যাকশন’; ‘দিয়েছি তো রক্ত/ আরও দেব রক্ত’—এমন আরও কিছু স্লোগান মিছিল–সমাবেশে অনুরণিত হয়েছে।
সিদ্দিকুর রহমান স্বপন তাঁর লেখা বইয়ে বলেছেন, ৬৯ সালের গণ–অভ্যুত্থানের সময় বাঙালির স্বকীয়তাবোধ যেমন তীব্রতর হতে থাকে, তেমনি স্লোগানে এর প্রভাব পড়তে থাকে। এই সময় ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ স্লোগানের আবেদন হ্রাস পেতে থাকে, এর পরিবর্তে বিভিন্ন বিপ্লবাত্মক স্লোগানের জন্ম নেয়।
১৯৬৯ সালের ছাত্র–জনতার আন্দোলনে বিভিন্ন সভা–সমাবেশে ‘তোমার দেশ আমার দেশ/ বাংলাদেশ বাংলাদেশ’; ‘জ্বালো জ্বালো/ আগুন জ্বালো’; ‘আইয়ুব–মোনায়েম ভাই ভাই/ এক দড়িতে ফাঁসি চাই’ স্লোগান শোনা যেত। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের স্লোগান ছিল ‘জেগেছে জেগেছে/ বাঙালি জেগেছে’; ‘বীর বাঙালি জেগেছে/ রক্তসূর্য উঠেছে’; ‘পুলিশ তুমি যতই মারো/ বেতন তোমার এক শ বারো’ প্রভৃতি।
অপর দিকে বামপন্থীদের স্লোগান ছিল ‘মুক্তির এই পথ/ সশস্ত্র বিপ্লব’; ‘কৃষক শ্রমিক অস্ত্র ধর/ জনগণতন্ত্র কায়েম কর’। মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সভা–সমাবেশে তাঁর কর্মীরা স্লোগান ধরতেন, ‘ভোটের আগে ভাত চাই/ নইলে এবার রক্ষা নাই’; ‘মোরা করেছি পণ/ হতে দেবো না নির্বাচন’।
লেখক–সাংবাদিক আবু সাঈদ খান তাঁর ‘স্লোগানে স্লোগানে রাজনীতি’ বইয়ে বলেছেন, ১৯৬৯ সালের গণ–অভ্যুত্থানে আরেকটি আলোচিত স্লোগান হলো ‘তোমার আমার ঠিকানা/ পদ্মা মেঘনা যমুনা’। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ভৌগলিক, সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে পূর্ব পাকিস্তান যে আলাদা, বাঙালি যে আলাদা; স্লোগানটিতে তা প্রতিফলিত হয়। অর্থাৎ পদ্মা মেঘনা যমুনা আমাদের ঠিকানা, আমাদের দেশ।
তিনি আরও বলেন, শেখ মুজিবের মুক্তি উনসত্তরের গণ–আন্দোলনের মূল দাবিতে পরিণত হয়। এ জন্য স্লোগান দেওয়া হতো—‘জেলের তালা ভাঙব/ শেখ মুজিবকে আনব’।
পূর্ব পাকিস্তান যখন গণ–অভ্যুত্থানে উত্তাল তখন জামায়াতে ইসলামি বাঙালির দাবির বিপক্ষে অবস্থান নেয়। সিদ্দিকুর রহমান স্বপন তাঁর বইয়ে বলেছেন, ‘পাকিস্তানের শত্রুরা হুঁশিয়ার সাবধান’; ‘কোরআন আইন কায়েম কর’ এমন নানা স্লোগান দিতেন দলটির নেতা–কর্মীরা। এমনকি মাওলানা ভাসানীর বিরুদ্ধে ‘সর্দি কাশি হাপানি/ মাওলানা ভাসানী’; চিড়িয়াখানার আজব প্রাণী/ মাওলানা ভাসানী’—এমন স্লোগানও শোনা যেত।
তবে ১৯৬৯ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর তারিখটা স্মরণীয় হয়ে থাকবে। আবু সাঈদ খান লিখেছেন, গণ–আন্দোলনের একপর্যায়ে ওই দিন ঢাকায় ছাত্রলীগের কর্মিসভায় সংগঠনের কর্মীদের একাংশ প্রথম ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতা আফতাব উদ্দিন আহমদ প্রথম জয় বাংলা স্লোগান ধরেন। পরবর্তী সময়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে এই স্লোগান অনুপ্রেরণার বড় ‘অস্ত্র’ হয়ে উঠেছিল।
১৯৯০: এরশাদবিরোধী
স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৯০ সাল ছিল ব্যাপক গণ–আন্দোলনের বছর। গদিতে তখন সামরিক স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। ১৯৯০ সালের ৪ ডিসেম্বর গণ–আন্দোলনের মুখে পদত্যাগের ঘোষণা দেন তিনি। এরও দুই দিন পর ৬ ডিসেম্বর গদি ছাড়েন এরশাদ। ওই সময় ছাত্র–জনতা এবং আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলো এক হয়ে এরশাদকে হটাতে রাজপথে নেমেছিল। দাবি ছিল—প্রেসিডেন্ট এরশাদের বিদায় ও নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করে দেশকে যথার্থ গণতান্ত্রিক ধারায় ফেরানো।
যাইহোক, এরশাদ পতনের আন্দোলনে ব্যাপক জনপ্রিয় স্লোগান ছিল ‘জনতার দাবি এক/ এরশাদের পদত্যাগ’; ‘এক দফা এক দাবি/ এরশাদ তুই কবে যাবি’; ‘এই মুহূর্তে দরকার/ তত্ত্বাবধায়ক সরকার’। আর এরশাদের পতনের পরপর স্লোগান উঠেছিল ‘এই মাত্র খবর এলো/ এরশাদ পালিয়ে গেল’।
আবু সাঈদ খান তাঁর বইয়ে লিখেছেন, এরশাদবিরোধী আন্দোলনে শহীদদের নাম (সেলিম, তাজুল, দীপা, বসুনিয়া, কাঞ্চন, ময়েজউদ্দিন প্রমুখ) বারবার স্লোগানে উঠে এসেছে। স্লোগান উঠতো ‘শহীদদের রক্ত/ বৃথা যেতে দেবোনা’; শোক নয় প্রতিশোধ নেবো আজ/ ঘুমাও শান্তিতে শাজাহান সিরাজ’; ‘বিপ্লবের লাল ফুল/ তাজুল’; ‘দীপা–কাঞ্চন ডাক পাঠাল, সব সাথীদের খবর দে/ বেঈমানি যাঁর শিরায় শিরায়, সেই দালালদের কবর দে’।
এরশাদবিরোধী গণ–আন্দোলনে একটি স্লোগান সবচেয়ে বেশি আলোড়ন তুলেছিল—‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক/ স্বৈরাচার নিপাত যাক’।
২০২৪: হাসিনাবিরোধী
এরশাদ–পরবর্তী গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে কখনো আওয়ামী লীগ, কখনো বিএনপি দেশ শাসন করেছে। সর্বশেষ ১৬ বছর টানা ক্ষমতায় ছিলেন শেখ হাসিনা। তাঁর নীতি, কথা ও কাজে ত্যক্ত–বিরক্ত হয়ে মানুষ রাজপথে নেমে আসে। ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট ক্ষমতা ও দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা।
সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে গত ১ জুলাই আন্দোলনে নামে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’। শুরুতে আন্দোলন অহিংসই ছিল। কিন্তু দমনপীড়নের পর সবশেষে সরকার পতনের এক দফা দাবিতে চলে আন্দোলন। ফলাফল, ৫ আগস্ট সরকারের পতন এবং শেখ হাসিনার পলায়ন।
সাহিত্যিক ও সাংবাদিক সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম গত ১২ আগস্ট ‘ছাত্র-জনতার আন্দোলনে বারুদ হয়ে ওঠা স্লোগানগুলো’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন লিখেছেন। ৩৬ দিনের আন্দোলনের কথা বলতে গিয়ে তিনি লিখেন, ‘আমি কে তুমি কে, রাজাকার, রাজাকার/ কে বলেছে, কে বলেছে, স্বৈরাচার, স্বৈরাচার’—এর মতো শ্লেষের প্রতিবাদ একপর্যায়ে রূপ নেয় সরকার পতনের এক দফা এক দাবিতে। ‘এক দুই তিন চার/ শেখ হাসিনা গদি ছাড়’; ‘লাখো শহীদের রক্তে কেনা/ দেশটা কারো বাপের না’-এর মতো কিছু স্লোগানও ওঠে।
২০২৪ সালের ছাত্র–জনতার আন্দোলনে ‘চাইলাম অধিকার হয়ে/ হয়ে গেলাম রাজাকার’; ‘আপস না সংগ্রাম/ সংগ্রাম সংগ্রাম’; ‘দালালি না রাজপথ/ রাজপথ রাজপথ’; ‘আমার সোনার বাংলায়/ বৈষম্যের ঠাঁই নাই’; ‘একাত্তরের হাতিয়ার/ গর্জে ওঠো আরেকবার’; ‘যে হাত গুলি করে/ সে হাত ভেঙে দাও’; ‘অ্যাকশন অ্যাকশন/ ডাইরেক্ট অ্যাকশন’; ‘আমার ভাই কবরে/ খুনিরা কেন বাইরে’; ‘আমার ভাই জেলে কেন’; ‘গুলি করে আন্দোলন/ বন্ধ করা যাবে না’; ‘জাস্টিস জাস্টিস/ উই ওয়ান্ট জাস্টিস’; ‘জ্বালো রে জ্বালো/ আগুন জ্বালো’; ‘দিয়েছি তো রক্ত/ আরও দেব রক্ত’—এমন স্লোগান শোনা যায়।
আন্দোলনের গতি আর এসব স্লোগান জোরালো হয়ে ওঠে আবু সাঈদের মৃত্যুর পর। রংপুরে গত ১৬ জুলাই পুলিশের গুলিতে নিহত হন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদ। সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই ঘটনার ভিডিও প্রকাশ পেলে আন্দোলনের গতি তীব্রতর হয়ে ওঠে। মিছিলে–সমাবেশে ‘আমার খায়, আমার পরে/ আমার বুকেই গুলি করে’; ‘লাশের ভেতর জীবন দে/ নইলে গদি ছাইড়া দে’; ‘ছি ছি হাসিনা/ লজ্জায় বাঁচি না’ স্লোগান দেওয়া হয়।
তবে দুটি স্লোগান যেন আদতেই বারুদ হয়ে আন্দোলনকারীদের রক্তে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল—‘বুকের ভেতর কঠিন ঝড়/ বুক পেতেছি গুলি কর’ এবং ‘লেগেছে লেগেছে/ রক্তে আগুন লেগেছে’।
এবারের আন্দোলনে শ্লেষাত্মক প্ল্যাকার্ড ও দেয়াললিখনে কিছু স্লোগান দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল। যেমন ‘তবে তাই হোক বেশ/ জনগণই দেখে নিক এর শেষ’; ‘অনাস্থা অনাস্থা/ স্বৈরতন্ত্রে অনাস্থা’; ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’; ‘চেয়ে দেখ এই চোখের আগুন/ এই ফাগুনেই হবে দ্বিগুণ’; ‘আমরা আমজনতা/ কম বুঝি ক্ষমতা’; ‘হাল ছেড় না বন্ধু বরং কণ্ঠ ছাড় জোরে’।
কিছু আদি বা পুরানো স্লোগান এবারও উচ্চারিত হয়েছে। যেমন ‘ভুয়া ভুয়া’; ‘জ্বালো রে জ্বালো/ আগুন জ্বালো’; ‘অ্যাকশন অ্যাকশন/ ডাইরেক্ট অ্যাকশন’; ‘স্বৈরাচারের দালারেরা/ হুঁশিয়ার সাবধান’। এমনকি ব্রিটিশবিরোধী লড়াইয়ের সাড়া জাগানো ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ স্লোগানটিও যেন এবার নতুন প্রাণ পেয়েছে।