জাহাঙ্গীর আলম, কোটচাঁদপুর
Thank you for reading this post, don't forget to subscribe!হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী তালের ডোঙ্গা। নতুন জন্মের কাছে অদ্ভুদ নাম। মাত্র ১ প্রজন্ম আগেও দক্ষিনাঞ্চলের অধিকাংশ বিল ও হাওর এলাকায় প্রচুর তালের ডোঙ্গা দেখা যেত, কিন্তু কালের স্রোতে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার কারনে তালের ডোঙ্গা আজ বিলুপ্তির পথে। এক সময় দক্ষিণাঞ্চলের সবকটি জেলার প্রতিটা গ্রামের মানুষের খাল, বিল ও নদী পারাপারের প্রধান বাহন ছিল এই তালের ডোঙ্গা।
আমরা যখন অনেক ছোট ছিলাম সেই ৯০ দশকের কথা তখনও ‘তালের ডোঙ্গা’ নামটি যশোর বা ঝিনাইদহ অঞ্চলে খাল, বড় বিল বা নদীতে চরে বেড়ানো জন্য বিশেষ এক নৌকা বা প্রধান বাহন হিসেবে পরিচিত ছিল। বর্তমান নতুন প্রজন্মের নিকট এ নামটি বেশ অপরিচিত। কারণ নদী, খাল বা বিল পারাপারে কোন জলযান প্রয়োজন হয় না। খাল ও বিল অনেক পরের বিষয় নদীগুলি বর্ষা মৌসুমেও শুকিয়ে থাকে। হেটেই পারাপারে থাকে না কোন সমস্যা।
‘তালের ডোঙ্গা’ নামটি শুনেই বুজতে বাকি থাকে না এটি তাল গাছ থেকে তৈরি করা এক বিশেষ জলযান । ডোঙ্গা শব্দের মূল উৎপত্তি হয়েছে ডিঙ্গি থেকে। ডিঙ্গি অর্থ ছোট। এটি মূল ডিঙ্গি নৌকারই আরএকটি রুপ।
এক সময় ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর অঞ্চলের অধিকাংশ বিল ও হাওর এলাকায় প্রচুর তালের ডোঙ্গা দেখা যেত, কিন্তু কালের স্রোতে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার কারনে তালের ডোঙ্গা আজ বিলুপ্তির পথে। কোটচাঁদপুরের কপোতাক্ষ নদ, চিত্রা নদী, বলুহর, জয়দিয়া, কুশনা বাওড়সহ সবকটি খাল বিলে গ্রামের মানুষের মাছ ধরার প্রধান বাহন ছিল এই তালের ডোঙ্গা।
যশোর, ঝিনাইদহ, মেহেরপর, চুয়াডাঙ্গা ও কুষ্টিয়া অঞ্চলের নদীগুলি মারা যাওয়ায় হারিয়ে যাচ্ছে এ অঞ্চলের বিশেষ জলযান ডিঙ্গি নৌকা খ্যাত তালের ডোঙ্গা। নদীগুলিতে পানির অভাব হওয়ায় খাল ও বিলে মিলছে না পানি। কিছু কিছু বছর বর্ষা মৌসুমেও মিলছে না পানি।
এ অঞ্চলের নদী গুলির উৎসমুখ পদ্মা বা ভারতের গঙ্গা নদীতে থেকে। গঙ্গা নদীর ওপর ফারাক্কা বাঁধ দেওয়া হয়েছে অনেক বছর আগেই। মূলত ফারাক্কা বাঁধের কারণেই ভাটির দেশ বাংলাদেশ অবস্থিত নদীগুলি পরিনিত হয়েছে খালে। শুষ্ক মৌসুমে তো পানির দেখা মেলাই দুরহু। নদী ও খালগুলিতে পানি না থাকায় স্থানীয় প্রভাবশালীরা খাল ও নদীর জায়গা দখল করে নির্মাণ করেছে বহুতল ভবন ও বিভিন্ন স্থাপনা। এমনকি কুষ্টিয়া, রাজশাহী অংশের মূল পদ্মা নদীতেও পানি কম থাকায় কৃষকরা ধান চাষ করে থাকেন। দেশের এ অংশের আগের ও বর্তমান মানচিত্রের মধ্যে ব্যাপক বে মিল লক্ষ করা যায়।
মূলত তালের ডোঙ্গা ব্যবহার করা হতো মাছ ধরা, শাপলা তোলা, শামুক সংগ্রহ সাঁকোবিহীন কোন খাল বা বিল পার হওয়ার জন্য। বিশেষ করে ঝিনাইদহ জেলার কোটচাঁদপুরের বিভিন্ন নদী, বাওড়, খাল বিলে এখন আর তালের ডোঙ্গা দেখা যায় না। তবে কোটচাঁদপুর উপজেলার কুশনা ইউনিয়নের বহরমপুরে হঠাৎ কানে ভেসে আসে খত খত শব্দ । ঘুরে তাকিয়ে দেখি লম্বা কালো মাটিতে পড়ে আছে। এক মাথা মোটা অন্য মাথা চিকন। লম্বা বাশের সাথে সাদা রংয়ের রশি বেধে একজন ব্যাক্তি মোটা মাথার দিকে খত খত শব্দ করে কি যেন করছে। কাছে গিয়ে দেখি তালের ডোঙ্গা তৈরি করছে মিস্ত্রী আতিয়ার রহমান, তার হাতে থাকা হাতুড়ি, বাটালি আর বাইশের সাহায্যে।
আতিয়ার রহমানের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি অনেক বছর ধরেই এই ডোঙ্গা তৈরির কাজ করে আসছি। এই গ্রামে শুধু আমিই তালের ডোঙ্গা তৈরী করতে পারি।
তিনি আরো বলেন, বর্তমান যুগের সন্তানরা তো এখন তালের ডোঙ্গা কি সেটা চিনে না। তবে প্রবীনরা বলেন এখনো বর্ষা মৌসুমে আমরা তালের ডোঙ্গার প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করি। আমি তালের ডোঙ্গা নির্মাতা হওয়ায় এলাকার মানুষ তার কাছে ডোঙ্গা তৈরীর জন্য আসতো। তার কাছ থেকে জানা যায়, তাল গাছের অধিক্যতার কারনে এই এলাকায় ডোঙ্গা নির্মাণ কাজ সহজ ছিলো, ডোঙ্গা তৈরীর কাজ করে অনেকে জীবিকা নির্বাহ করতো। নানা প্রতিবন্ধকতার কারনে তালের ডোঙ্গা নির্মাতারা হারিয়ে গেছে, সেই সাথে হারিয়ে গেছে তালের ডোঙ্গাও। বর্তমানে দেশের তালের ডোঙ্গা নির্মাণ হয় না বললেই চলে ।
মিস্ত্রী আতিয়ার রহমান সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে বলেন, ডোঙ্গা টিকিয়ে রাখতে নদী খনন করতে হবে। তালের ডোঙ্গা পরিবেশ বান্ধব ও সহজ নৌযান। এ ধরনের নৌযান টিকিয়ে রাখার জন্য সরকারি উদ্দ্যোগ খুবই প্রয়োজন। না হলে নতুন প্রজন্মের সন্তানরা তালের ডোঙ্গা আর চিনবে না।