খুনের মামলার আসামি টেস্ট ম্যাচ খেলছেন! ভাবতেই অবাক লাগে, কিন্তু তা বাস্তবে দেখতে পারছেন বিশ্ববাসী। কিছুক্ষণ পর পর সাকিবকে টেলিভিশনের পর্দায় দেখা যাচ্ছে। সাকিব ফিল্ডিং করছেন, বোলিং করছেন, উইকেটও নিচ্ছেন। একজন আসামি স্বাধীনভাবে দৌড়াচ্ছেন মাঠে। কিন্ত তাকে ধরার জন্য কোনো পুলিশ নেই। হাতে হাতকড়া তা থাকলেতো তিনি খেলতেই পারতেন না। তাঁর অবদান যোগ হচ্ছে বাংলাদেশের অর্জনে।
Thank you for reading this post, don't forget to subscribe!পাকিস্তানের বিপক্ষে ১০ উইকেটে জেতা রাওয়ালপিন্ডি টেস্টের প্রথম ইনিংসে সাকিবের অবদান ১ উইকেট আর ১৫ রান। দ্বিতীয় ইনিংসে ১৭ ওভারে ৪৪ রান দিয়ে নিয়েছেন ৩ উইকেট এবং ৩টি উইকেটই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমটি ওপেনার আবদুল্লাহ শফিকের। এরপর ফেরান প্রথম ইনিংসের সেঞ্চুরিয়ান সৌদ শাকিল, সবশেষে নিয়েছেন নাসিম শাহর উইকেট।
তবে যে টেস্টে মুশফিকুর রহিমের নান্দনিক ১৯১ রানের ইনিংস থাকে বা সাদমান-মিরাজদের অমন ফিফটি অথবা উইকেট সংখ্যায় এগিয়ে থাকেন মিরাজ, সেখানে সাকিবের এই ৩ উইকেটেরও বিশেষ কিছু হয়ে ওঠার কোনো কারণ নেই। তাঁকে নিয়ে আলোচনার কোনো ক্রিকেটীয় সূত্রও নেই আপাতত।
তারপরও প্রথম টেস্ট জয়ের পর অস্বস্তির তেতো ঢেকুর তোলা প্রশ্নটা করতেই হচ্ছে—৩০ আগস্ট শুরু সিরিজের দ্বিতীয় ও শেষ টেস্টে সাকিব কি খেলবেন?
জয়োৎসবের দিনেও এমন প্রশ্ন করার কারণটা নিশ্চয়ই সবার জানা। আইনের দৃষ্টিতে সাকিব এ মুহূর্তে একজন খুনের মামলার আসামি। রাওয়ালপিন্ডি টেস্ট চলাকালেই ঢাকায় এক খুনের মামলায় আরও অনেকের সঙ্গে আসামি করা হয়েছে আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য সাকিব আল হাসানকে।
একজন হত্যা মামলার আসামি জাতীয় দলের হয়ে টেস্ট খেলছেন— গত দু-তিন দিন এ নিয়েই চলছে তুমুল আলোচনা। এদিকে এ মামলায় বিসিবিকে আইনি নোটিশ দেওয়া হয়েছে, মামলার তদন্তের স্বার্থে জাতীয় দল থেকে বাদ দিয়ে এ অলরাউন্ডারকে যেন দেশে ফিরিয়ে আনা হয়।
তো দেশে যখন এই পরিস্থিতি, রাওয়ালপিন্ডিতে কেমন কাটছে সাকিবের সময়? জয়ের মৌতাতে থেকেও সময়টা উপভোগ্য হওয়ার কথা নয় তাঁর জন্য।
অন্য অনেকের সঙ্গে সাকিবের পার্থক্য হলো কঠিন পরিস্থিতিও তিনি দারুণভাবে সামলে নেন। ভেঙে তো পড়েনই না, উল্টো কখনো কখনো এরকম সময়েই বের হয়ে আসে তাঁর সেরাটা। কিন্তু এবারের ব্যাপারটা পুরোই আলাদা।
রাওয়ালপিন্ডিতে খবর নিয়ে যা জানা গেছে, তাতে অবশ্য সাকিব এবারও খুব বেশি ভেঙে পড়েছেন বলে মনে হচ্ছে না। তার একটা প্রমাণ তো মাঠে তাঁর উপস্থিতি আর পারফরম্যান্সই। বাকিটা এই প্রতিবেদককে মুঠোফোনে জানিয়েছেন বাংলাদেশ দলের এক সদস্য, ‘তার (সাকিব) নামে হত্যা মামলা হয়েছে, একটু তো চিন্তা থাকবেই। তবে এখানে দল তার কাছে পুরোটাই পাচ্ছে। ভেতরে কোনো দুশ্চিন্তা থাকলেও সেটার ছায়া সে দলে পড়তে দিচ্ছে না।’
তিনি বলেন, ‘সাকিব শতভাগ পেশাদার একজন ক্রিকেটার এবং এই পরিস্থিতিতেও আমরা পেশাদারি মানসিকতাই দেখছি তার মধ্যে। মাঠের খেলায় সে পুরোপুরি নিবেদিত প্রাণ। আর মানসিকভাবে সতীর্থরা তাকে খুব সমর্থন দিচ্ছে।’
সতীর্থদের একজন মুমিনুল হক তো তাঁর ভেরিফায়েড ফেসবুকে গতকাল এই দাবিও করেছেন, সাকিবের বিরুদ্ধে মামলাটি মিথ্যা। তিনি লিখেছেন, ‘প্রায় ১৮ বছর ধরে দেশের ক্রিকেটে প্রতিনিধিত্ব করছেন সাকিব আল হাসান। দেশের ক্রিকেটে তাঁর হাত ধরে এসেছে কত জয়! সেই মানুষটা এখন মিথ্যা মামলার আসামি!
গার্মেন্টসকর্মী হত্যা মামলায় দায়ে অভিযুক্ত সাকিব ভাই তখন কানাডায় খেলছিলেন। দেশেও ছিলেন না লম্বা সময়। সাকিব ভাইয়ের নামে এমন মামলা অপ্রত্যাশিত। এমন ঘটনা দেশের ক্রিকেটের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে পারে।
যে ছাত্র-জনতার রক্তে নতুন বাংলাদেশ দেখলাম, সেই বাংলাদেশে প্রশ্নবিদ্ধ মামলা করে হয়রানি অপ্রত্যাশিত। আমরা চাই নতুন বাংলাদেশে সবাই ন্যায়বিচার পাবে।
ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানের প্রতি সব সময়ই সমর্থন ছিল, আছে এবং থাকবে। সংকট কাটিয়ে নিশ্চয়ই ভক্তদের ভালোবাসায় আগের মতোই সিক্ত হবে সাকিব ভাই।’
কিন্তু যত যা–ই হোক, আইনের চোখে তো সাকিব আসামি। টেস্টের মাঝামাঝি সময়ে মামলা হয়েছে বলে প্রথম টেস্টটা না হয় খেলে ফেলেছেন। কিন্তু পরের টেস্টের দলে কি তাঁকে রাখবে বিসিবি?
গত পরশুপরিচালকদের এক সভার পর এ নিয়ে বোর্ডের অবস্থান জানাতে গিয়ে বিসিবি সভাপতি ফারুক আহমেদ বলেছিলেন, প্রথম টেস্ট শেষে তাঁরা এ নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন।
গতকাল প্রথম টেস্ট শেষে স্বাভাবিকভাবেই ফারুককে পাওয়া গেল বেশ উৎফুল্ল মেজাজে। তিনি বোর্ডের দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথম ম্যাচেই এমন জয়! তারপরও অস্বস্তিকর এক প্রশ্ন করতে হলো তাঁকে—পরের ম্যাচ কি খেলবেন তিনি?
পাকিস্তান ৪৪৮ রান করে ফেলার পরও প্রথম ইনিংসে ৫৬৫ রান করে বাংলাদেশের ১১৭ রানের লিড, দ্বিতীয় ইনিংসে বোলারদের দারুণভাবে ফিরে আসা এবং শেষ পর্যন্ত ১০ উইকেটের জয়—প্রথম টেস্টের দিকে ফিরে তাকিয়ে ফারুক দেখছেন বাংলাদেশ দলের অদম্য এক মানসিকতা। মুশফিকুর রহিমকে তো ফোন করে অভিনন্দনও জানিয়েছেন। দলের মাথায় এমন মুকুট পরানোর দিনে সেই দলেরই একজন ক্রিকেটারকে নিয়ে নেতিবাচক প্রসঙ্গে যেতে চাইলেন না বিসিবির নতুন সভাপতি।
ক্রিকেট বোর্ড সাকিবের ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্তে পৌছেছে কি না জানতে চাইলে বোর্ড সভাপতি হেসে বলেছেন, ‘এ মুহূর্তে এসব ভাবতে চাইছি না। এ নিয়ে কথাও বলতে চাইছি না। এটা উপভোগের সময়। আমি এখন শুধুই এই ঐতিহাসিক জয়টা উপভোগ করতে চাই। ওসব পরে হবে।’
রাওয়ালপিন্ডিতেই পরের টেস্টে জিতলে তো বটেই, টেস্টটা ড্র হলেও সিরিজ বাংলাদেশের। তার আগে নাজমুল হোসেনের দলের উইনিং কম্বিনেশনে কি হাত দেবে বিসিবি? যেখানে দলের অন্য সদস্যরা ‘হত্যা মামলার আসামি’ সাকিবের পাশে।