প্রবন্ধ রচনা
আতাউর রহমান সায়েম
সিনিয়র শিক্ষক (বাংলা)
আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ
মতিঝিল, ঢাকা
ভূমিকা: ‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া…
একটি ধানের শিষের উপর একটি শিশির বিন্দু।’
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
মানুষ ভ্রমণ করতে পছন্দ করে। এই পছন্দকে কাজে লাগিয়ে ভ্রমণবান্ধব এক ধরনের ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, যার নাম পর্যটনশিল্প। এই শিল্পের কাজ হলো কোনো অঞ্চলের দর্শনীয় স্থানগুলোর তথ্য ভ্রমণপিপাসু মানুষের কাছে তুলে ধরা, ভ্রমণের সুবন্দোবস্ত করা এবং এর মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করা। বাংলাদেশের একাধিক বনাঞ্চল, পাহাড়-নদী-ঝর্ণা, শস্যশোভিত মাঠ ও সবুজ প্রকৃতি, বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত, নান্দনিক স্থাপত্য ও ভাস্কর্য, প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা ও নিদর্শন প্রভৃতি দেশ-বিদেশের পর্যটকদের আকর্ষণ করে। তাই বাংলাদেশে পর্যটনশিল্পের সম্ভাবনা প্রচুর। এগুলোর টানে বিপুলসংখ্যক বিদেশি পর্যটকের বাংলাদেশে আসার সুযোগ রয়েছে। এভাবে বাংলাদেশ পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারে। এটি বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
পর্যটনের সংজ্ঞার্থ: অল্প কথায় বা নির্দিষ্ট কিছু মানদণ্ডের আলোকে পর্যটনকে সংজ্ঞায়িত করা কঠিন। কারণ একেকজনের দৃষ্টিতে পর্যটন একেক রকম। সহজ কথায়, পার্থিব সৌন্দর্য উপভোগ করার উদ্দেশ্যে মানুষের দর্শনীয় স্থানে অবস্থান এবং এর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত কর্মকাণ্ডকে পর্যটন বলে। পর্যটনকে কেন্দ্র করে যখন অর্থনীতি আলাদা একটি গতি পায় তখন তাকে বলে পর্যটনশিল্প। আন্তর্জাতিক পর্যটন বিশেষজ্ঞ সংস্থার সংজ্ঞানুযায়ী ‘পর্যটন হলো- কোনো উপার্জনমূলক কাজে যুক্ত নয় এবং স্থায়ীভাবে বসতি গড়ে না এমন ব্যক্তির ভ্রমণ এবং কোথাও থাকা থেকে উৎসারিত প্রপঞ্চ এবং সম্পর্কের সমষ্টি।
পর্যটনশিল্পের গুরুত্ব: একটি দেশের পর্যটনশিল্প বিকশিত হলে সেই দেশের সংস্কৃতিও সমৃদ্ধ হয়। পর্যটন এলাকায় অধিবাসীদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। মানুষের অর্থনৈতিক উন্নতি ত্বরান্বিত হয়। পর্যটকদের আগ্রহ রয়েছে এমন স্থান, স্থাপনা বা বিষয়ের প্রতি স্থানীয় অধিবাসীদেরও শ্রদ্ধাশীল করে তোলে। তারা নিজেদের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি রক্ষায় তাগিদ অনুভব করে। এ ছাড়া পর্যটনের সূত্রে বিভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতির মানুষের মেলবন্ধন একটি মানবিক বিশ্ব তৈরিতে ভূমিকা রাখতে পারে।
পর্যটনকেন্দ্রসমূহ: আমাদের বাংলাদেশ অনেক সুন্দর। এ দেশের প্রকৃতির সৌন্দর্যে অনেকেই মুগ্ধ হয়। তাইতো কবি বলেছেন-
‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি,
সকল দেশের রাণী সে যে- আমার জন্মভূমি।’
– (ধনধান্য পুষ্পভরা: দ্বিজেন্দ্রলাল রায়)
বাংলাদেশে অনেক পর্যটনকেন্দ্র রয়েছে। যেমন-
১. সুন্দরবন: বাংলাদেশের উপকূলবর্তী অঞ্চলে ৬ হাজার বর্গকিলোমিটারের অধিক জায়গাজুড়ে সুন্দরবন অবস্থিত। এটি পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল। খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা ও বরগুনা জেলায় এর অবস্থান। সুন্দরী বৃক্ষ, গোলপাতাসহ নানা জাতের উদ্ভিদ এবং চিত্রল হরিণ, বাঘ, বানর, হনুমানসহ নানা জাতের পশুপাখির আবাস এই সুন্দরবন। এর অভ্যন্তরে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য খালে রয়েছে কুমির। রোমাঞ্চপ্রিয় পর্যটকরা নৌযানে করে সুন্দরবনের সৌন্দর্য উপভোগ করতে যেতে পারেন। ভয় ও ভালো লাগার অপূর্ব মিশেলের কারণে সুন্দরবন ভ্রমণ যেকোনো পর্যটকের স্মৃতিতে স্থায়ী হয়ে থাকে।
২. সিলেটের রাতারগুল: সিলেট জেলার গোয়াইনঘাটে অবস্থিত রাতারগুল জলাবন বাংলাদেশের একমাত্র মিঠাপানির বন। এর আয়তন ৩ হাজার ৩২৫ একর। রাতারগুলে ১০ ফুট গভীর পানির ওপর বনের গাছপালা জেগে থাকে। বর্ষাকালে পানির গভীরতা হয় ২০-৩০ ফুট পর্যন্ত। পর্যটকদের নৌকায় করে বনের মধ্যে প্রবেশ করতে দেখা যায়। এখানে উপভোগ করার মতো আছে কদম, হিজল, অর্জুন, ছাতিম প্রভৃতি গাছের সৌন্দর্য। বেড়াতে গিয়ে দেখা হয়ে যায় বানর, বেজি, গুঁইসাপ কিংবা সাদা বক, মাছরাঙা, পানকৌড়ি প্রভৃতি প্রাণী ও পাখির সঙ্গে।
৩. সমুদ্রসৈকত ও সেন্টমার্টিন: কক্সবাজারে অবস্থিত কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত পৃথিবীর দীর্ঘতম (১২০ কিলোমিটার দীর্ঘ) প্রাকৃতিক সমুদ্রসৈকত। সমুদ্রের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পর্যটকরা ভিড় করেন কক্সবাজারে। সমুদ্র ছাড়াও কক্সবাজার জেলায় রয়েছে একাধিক ক্ষুদ্র জাতিসত্তার ধর্মীয় উপাসনালয় ও বুদ্ধ মূর্তি। স্থাপত্যশিল্পের বিচারে এগুলো অমূল্য। এ ছাড়া চট্টগ্রামের পতেঙ্গা, কক্সবাজারের ইনানি, পটুয়াখালীর কুয়াকাটা, সুন্দরবনের কটকা প্রভৃতি সমুদ্রসৈকতে ভ্রমণপিপাসুরা বেড়াতে যান। বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণে অবস্থিত সেন্টমার্টিন দ্বীপ বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ। দ্বীপজুড়ে রয়েছে নারিকেল গাছ। দ্বীপ থেকে সমুদ্রের নীল জলরাশির সৌন্দর্য উপভোগ করতে এবং নানা রকমের প্রবাল দেখতে পর্যটকরা সেন্টমার্টিন দ্বীপে ভ্রমণ করেন।
৪. পার্বত্য অঞ্চল-প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার: বাংলাদেশের পার্বত্য জেলাগুলো অর্থাৎ রাঙামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাক্ষেত্র। একদিকে সুউচ্চ পাহাড়ের চূড়ায় উঠে মেঘ ছোঁয়ার আনন্দ, অন্যদিকে প্রাকৃতিক জলের উৎস ঝর্ণাধারা পর্যটকদের অভিভূত করে। রাঙামাটির কাপ্তাই হ্রদে নৌকায় ভেসে বেড়ানো যায়। হ্রদের ওপরে একটি সুদৃশ্য ঝুলন্ত সেতু রয়েছে। খাগড়াছড়ি জেলার অন্তর্গত আলুটিলা পাহাড়, রিসাং ঝর্ণা, মায়াবিনী লেক প্রভৃতি স্থানে ভ্রমণের হাতছানি পর্যটকরা অগ্রাহ্য করতে পারে না।
৫. জাফলং ও মাধবকুণ্ড ঝর্না: সিলেটের জাফলংয়ের পিয়াইন নদীতে মনোমুগ্ধকর পাথুরে জলের ধারা, মৌলভীবাজারের মাধবকুণ্ড ঝর্ণা; হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, শ্রীমঙ্গল ও পঞ্চগড়ের চা বাগান; শ্রীমঙ্গলের ইকোপার্ক প্রভৃতি স্থান প্রায় সারা বছরই পর্যটকদের পদচারণায় মুখরিত থাকে। এ অঞ্চলগুলো ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষদের বর্ণিল জীবনাচারও পর্যটকদের আকর্ষণ করে। বাংলাদেশের একমাত্র পার্বত্য দ্বীপ মহেশখালী। বিখ্যাত আদিনাথ মন্দির ও বড় রাখাইনপাড়া বৌদ্ধমন্দির এই দ্বীপেই অবস্থিত।
৬. পুরাকীর্তি ও প্রত্ন নিদর্শন: বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলোর রয়েছে ঐতিহাসিক গুরুত্ব। পুরান ঢাকার লালবাগে অবস্থিত মুঘল স্থাপত্যের লালবাগ কেল্লা, বুড়িগঙ্গার তীরে নির্মিত আহসান মঞ্জিল, নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে গড়ে ওঠা অনুপম স্থাপত্যশৈলীবিশিষ্ট পানাম নগর, কুমিল্লায় আবিষ্কৃত প্রাচীন নগর ময়নামতী, বগুড়ার প্রাচীন পুরাকীর্তি মহাস্থানগড়, নরসিংদী জেলার বেলাব উপজেলার অন্তর্গত আড়াই হাজার বছর আগের প্রত্ননিদর্শন সংবলিত উয়ারী ও বটেশ্বর গ্রাম, নওগাঁ জেলায় আবিষ্কৃত পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বৌদ্ধবিহার পাহাড়পুর, বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ মসজিদসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে রয়েছে প্রাচীন ও আধুনিক স্থাপত্যকলার বহু নিদর্শন।
৭. ঐতিহাসিক স্থাপনা: এদেশে নির্মিত ঐতিহাসিক স্থাপন্যগুলো রাজনৈতিক ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করছে। ১৯৫২ সালে সংঘটিত ভাষা আন্দোলনের শহিদদের স্মরণে ঢাকা মেডিকেল প্রাঙ্গণে স্থাপিত কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের শহিদদের প্রতি নিবেদিত ও ঢাকার সাভারে অবস্থিত জাতীয় স্মৃতিসৌধ, ঢাকার শাহবাগে অবস্থিত জাতীয় জাদুঘর, ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর নিহত বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে ঢাকার মিরপুরে নির্মিত বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ, ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এবং এই উদ্যানে স্থাপিত স্বাধীনতা জাদুঘর ইতিহাসপ্রেমী পর্যটকদের আকৃষ্ট করে।
বাংলাদেশে পর্যটনশিল্পের অবস্থা: পর্যটন বিশ্বব্যাপী একটি সম্ভাবনাময় খাত। বিভিন্ন পরিসংখ্যানে জানা যায়, বিশ্বজুড়ে পর্যটকদের সম্মিলিত বার্ষিক ভ্রমণ-ব্যয় ৫০ হাজার কোটি টাকা। এমন অনেক দেশ রয়েছে, যাদের প্রধান আয়ের উৎস পর্যটন। বাংলাদেশের পর্যটনশিল্প দিনে দিনে বিকাশ লাভ করছে। একদিকে বিদেশি পর্যটকদের আগমন দেশের বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় বাড়িয়ে তুলছে, অন্যদিকে দেশীয় পর্যটকদের ভ্রমণ সামগ্রিক অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে প্রতি বছর ৫০ থেকে ৬০ লাখ দেশীয় পর্যটক বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করে। এদের বেশির ভাগই মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। এই বিপুলসংখ্যক পর্যটক বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করায় পর্যটনের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে দেশের অর্থনীতি গতি লাভ করছে। পরিবহন, আবাসিক হোটেল, রেস্তোরাঁ, পোশাক, অলংকার প্রভৃতি ব্যবসা পর্যটনশিল্পের বিকাশের সঙ্গে জড়িত। পর্যটনের বিকাশে অসংখ্য মানুষের জীবিকার সংস্থান হয়। বর্তমানে প্রায় ১২ লাখ মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পর্যটনশিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থেকে জীবিকা নির্বাহ করছে। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, পর্যটনশিল্প থেকে ১০ শতাংশ পর্যন্ত জিডিপি অর্জন করা সম্ভব।
বাংলাদেশের পর্যটনশিল্প
বাংলাদেশে পর্যটনশিল্পের অর্থনৈতিক গুরুত্ব: বর্তমান সময়ের দ্রুত বিকাশমান একটি শিল্প হলো পর্যটনশিল্প। এ শিল্প তার বহুমাত্রিক বৈচিত্র্যের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শীর্ষ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাতে পরিণত হয়েছে। প্রতি বছর বাংলাদেশে পর্যটনশিল্পে উপার্জন বাড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ১৯৯৯ সালে পর্যটন খাত থেকে বাংলাদেশের আয় হয়েছিল ২৪৫ কোটি ১৯ লাখ টাকা। এটি বেড়ে গিয়ে ২০০৮ সালে ৬১২ কোটি ৪৫ লাখ ২০ হাজার টাকায় দাঁড়ায়। বাংলাদেশের GDP-এর প্রায় ২ শতাংশ আসে পর্যটন খাত থেকে। পর্যটনশিল্পে প্রায় ১০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। ২০১২ সালে মোট জিডিপির ৪ দশমিক ৩ শতাংশ এসেছে পর্যটন খাত থেকে, টাকার অঙ্কে যা প্রায় ৩৯ হাজার ৮০ কোটি টাকা। এ ছাড়া কেবল ২০১২ সালেই পর্যটন খাতের সঙ্গে জড়িত ছিল ১২ লাখ ৮১ হাজার ৫০০ কর্মকর্তা-কর্মচারী। যা মোট চাকরির ১ দশমিক ৮ শতাংশ। (সূত্র: WOTTC Report 2012)
বাংলাদেশ পর্যটনশিল্পের সমস্যাগুলো: বাংলাদেশের অর্থনীতির বড় নিয়ামক পর্যটনশিল্প নানামুখী সমস্যায় জর্জরিত। বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশে পর্যটনশিল্পের সুষ্ঠু বিকাশ হচ্ছে না। বাংলাদেশের পর্যটনশিল্পের সমস্যাগুলো হলো-
১) রাজনৈতিক অস্থিরতা: বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতাই পর্যটনশিল্পের জন্য বড় হুমকি। বিভিন্ন সময় বাংলাদেশে রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তপ্ত থাকার কারণে এ দেশের পর্যটনশিল্পের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়।
২) যোগাযোগ এবং অবকাঠামোগত সমস্যা: পর্যটনকেন্দ্রগুলোয় যাওয়ার মতো যেমন আরামদায়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাব ঠিক তেমনি সেখানকার আবাসন ব্যবস্থাও ভালো নয়। তাই পর্যটনকেন্দ্রগুলো আকর্ষণীয় হলেও পর্যটকরা যাওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।
৩) আকর্ষণীয় প্রচারণার অভাব: পর্যটনকেন্দ্রগুলোর সৌন্দর্য নিয়ে আকর্ষণীয় প্রচারণা চালানো হয় না। ফলে সৌন্দর্যপিপাসু মানুষ এসব আকর্ষণীয় স্থান সম্পর্কে জানতে পারে না।
৪) দক্ষ গাইডের অভাব: বিদেশি পর্যটকদের পথ দেখানো থেকে শুরু করে পর্যটনকেন্দ্র সম্পর্কিত ইতিহাস ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য যে দক্ষ গাইডের প্রয়োজন বাংলাদেশে তার বড়ই অভাব। দোভাষী গাইডের সংখ্যা যত বৃদ্ধি করা যাবে বাংলাদেশে তত বেশি বিদেশি পর্যটক আসবে।
৫) সরকারি উদ্যোগের অভাব: বাংলাদেশের সরকার পর্যটনের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ খাতকে সবসময়ই অবহেলা করে এসেছে। পর্যটনকেন্দ্রগুলোর ব্যবস্থাপনা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সরকারের অগ্রাধিকার তালিকায় থাকার কথা থাকলেও স্বাধীনতার ৪৩ বছর পরেও তা সম্ভব হয়নি।
৬) বেসরকারি উদ্যোগের অভাব: বাংলাদেশের বেসরকারি উদ্যোক্তাদের মধ্যে খুব কমই আছেন যারা পর্যটনশিল্পের দিকে মনোযোগ দিয়ে থাকেন। প্রায় সব দেশেই পর্যটনশিল্প সমৃদ্ধ হয়েছে সে দেশের বেসরকারি উদ্যোক্তাদের উদ্যোগে। কিন্তু বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ করার সুষ্ঠু পরিবেশ এবং নিশ্চিত নিরাপত্তার অভাববোধ থেকে পর্যটন খাতে বিনিয়োগ করতে চান না।
৭) পর্যাপ্ত এবং উন্নত প্রশিক্ষণের অভাব: পর্যটকদের বারবার আকৃষ্ট করার জন্য পর্যটনকেন্দ্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত সব কর্মকর্তা এবং কর্মচারীদের উন্নত এবং পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশে এ ধরনের ব্যবস্থা খুবই সীমিত।
৮) নিরাপত্তার অভাব: বাংলাদেশের পর্যটনশিল্পে নিরাপত্তার অভাব পরিলক্ষিত হয়। বিভিন্ন খবরের কাগজে প্রায় খবর আসে বিদেশিরা বিভিন্নভাবে প্রতারিত বা ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। পর্যটনকেন্দ্রগুলোয় পূর্ণ নিরাপত্তার অভাবের কারণে বিদেশিরা অনেক সময় বাংলাদেশে আসেন না।
বাংলাদেশের পর্যটনশিল্পের উন্নয়নে করণীয়: বাংলাদেশের উন্নয়নের গতির ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য পর্যটনশিল্পের সমৃদ্ধি প্রয়োজন। এ জন্য সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি নিম্নোক্ত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা যেতে পারে-
১) পর্যটন নীতিমালার সুষ্ঠু বাস্তবায়ন করতে হবে।
২) পর্যটনকেন্দ্রগুলোয় সহজে পৌঁছানো যায় এমন যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
৩) বিদেশি পর্যটকরা যাতে নির্বিঘ্নে অবস্থান করতে পারেন তার ব্যবস্থা করতে হবে।
৪) পর্যটন বিষয়ে ব্যাপক গণশিক্ষা এবং স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীদের পর্যটন বিষয়ে শিক্ষা দিতে হবে।
৫) প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণে দেওয়ার মাধ্যমে দক্ষতা সম্পন্ন পর্যটক গাইড (Tourist Guide) গড়ে তুলতে হবে।
৬) পরিবহন খাতের ঝুঁকি কমাতে হবে। যাতে দেশি-বিদেশি পর্যটকরা কোনো ঝামেলা ছাড়াই বিমান, লঞ্চ, বাস বা অন্যান্য যানবাহনে করে পর্যটনকেন্দ্রে পৌঁছাতে পারে।
৭) সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে পর্যটনকেন্দ্রগুলোকে আকর্ষণীয় করে তুলতে হবে।
৮) বাংলাদেশের প্রাকৃতিক নৈসর্গিক দৃশ্যগুলোকে প্রচারণার মাধ্যমে উপস্থাপন করে পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে হবে।
৯) সর্বোপরি দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার মাধ্যমে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হবে।
১০) যাতায়াত এবং থাকা-খাওয়াসহ সংশ্লিষ্ট ব্যয় যাতে ভ্রমণকারীদের সীমার মধ্যে থাকে তা বিবেচনায় নেওয়া উচিত।
উপসংহার: বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, স্থাপত্যকলা, স্থানীয় অধিবাসীদের বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবন ও সংস্কৃতি পর্যটকদের আকর্ষণ করার জন্য যথেষ্ট। তবে পর্যটনকে একটি শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে ও স্থায়ী রূপ দিতে দরকার রাষ্ট্রীয় নীতিমালা ও এর প্রয়োগ। স্থানীয় প্রশাসনের পাশাপাশি পর্যটনকেন্দ্রের অধিবাসীদেরও পর্যটকদের সহযোগিতায় সম্পৃক্ত করা উচিত। পর্যটকদের যথাযথ নিরাপত্তা ও সহযোগিতা দেওয়া গেলে ভ্রমণের প্রতি তাদের উৎসাহ আরও বাড়বে। ফলে একদিকে যেমন বাংলাদেশের মানবিক সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্যের পরিচয় বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়বে, অন্যদিকে দেশের অর্থনীতির চাকা আরও গতিশীল হবে। তখন সবাই মুগ্ধ হয়ে কবি জীবনানন্দ দাশের মতো বলবে-
বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি
তাই পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর।