আতাউর রহমান সায়েম
সিনিয়র শিক্ষক (বাংলা)
আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মতিঝিল, ঢাকা
পিতা-মাতার প্রতি কর্তব্য
Thank you for reading this post, don't forget to subscribe!ভূমিকা: প্রত্যেক মানুষেরই জীবন ও অস্তিত্ব পিতা-মাতার সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত। এ পৃথিবীতে কোনোভাবেই কোনো সন্তান বাবা-মায়ের ঋণ শোধ করতে পারে না। সন্তানের কাছে পিতা-মাতার আসন সবার ওপরে। জন্মের পর থেকে সন্তান লালিত-পালিত হয় পিতা-মাতার সাহচর্যে, নিবিড় স্নেহছায়ায়। সন্তানের আচরণ, শিক্ষা এককথায় জীবন গড়ে ওঠে পিতা-মাতার প্রভাবে। তাই সব সন্তানের উচিত তাদের অপার স্নেহের প্রতিদান দেওয়া। পাশ্চাত্য মনীষী রাস্কিন এ পৃথিবীতে তিনটি কর্তব্যের কথা বলেছেন, ‘Duty towards God, duty towards parents and duty towards mankind’.
বিভিন্ন ধর্মে পিতা-মাতার অবস্থান: প্রত্যেক ধর্মেই পিতা-মাতাকে সম্মানজনক স্থান দিয়ে তাদের সামাজিক মর্যাদার আসনটিকে গৌরবান্বিত করা হয়েছে। ইসলামে ‘মাতার পদতলে সন্তানের বেহেশত’ ঘোষিত হয়েছে। পাশাপাশি বলা হয়েছে, ‘পিতা-মাতার সন্তুষ্টি ছাড়া সন্তানের জান্নাত প্রাপ্তি অনিশ্চিত।’ হিন্দু ধর্মে বর্ণিত আছে, ‘জননী স্বর্গ অপেক্ষা গরীয়সী।’ আবার বলা আছে, ‘পিতা স্বর্গ, পিতা ধর্ম; পিতাই পরম তপস্যার ব্যক্তি। পিতাকে সন্তুষ্ট করলে সব দেবতা সন্তুষ্ট হন।’ খ্রিষ্টধর্মেও এরূপ কথা বলা হয়েছে। সর্বোপরি প্রত্যেক ধর্ম পিতা-মাতাকে তাদের যোগ্য অবস্থানের স্বীকৃতি দিয়েছে। কোনো ধর্মই পিতা-মাতার উচ্চ আসনকে খর্ব করেনি।
পিতা-মাতার ভূমিকা: পৃথিবীর আলোতে সন্তানের দিনযাপন শুরু হওয়ার আগেই মাতৃগর্ভে সন্তানের জন্ম ও বৃদ্ধি ঘটতে থাকে। মা পরম ভালোবাসায় তার সন্তানকে গর্ভে ধারণ করে অবর্ণনীয় কষ্টকে হাসিমুখে গ্রহণ করে সন্তানকে পৃথিবীর মুখ দেখান। পৃথিবীতে আসার পর সন্তান চরম অসহায় থাকে, কেননা জন্মমাত্রই শিশু আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠতে পারে না। এমনকি সে বেঁচে থাকার জন্য অনিবার্য খাদ্যটুকুও মায়ের সহযোগিতা ছাড়া গ্রহণ করতে পারে না। পিতা-মাতার যুগল প্রচেষ্টা এবং সেবায় বড় হতে থাকে শিশু। সন্তানের পড়াশোনা নিশ্চিত করা, ভরণ-পোষণ, স্বাস্থ্যের প্রতি মনোযোগ ইত্যাদি বিষয়ে পিতা-মাতা যত্নশীল। তত্ত্বাবধানের পর যতক্ষণ না সন্তান স্বাবলম্বী বা আত্মনির্ভরশীল হবে সে পর্যন্ত পিতা-মাতার কোনো স্বস্তি নেই। মোদ্দাকথা, জীবনের সুদীর্ঘ সময় সন্তানের প্রতি পিতা-মাতা থাকেন নির্ভরশীল সহায়ক শক্তি হয়ে; যে শক্তির ওপর সন্তান রচনা করে তার অনাগত দিনের ভিত্তি। তাই সন্তানের প্রতি পিতা-মাতার এ অবদানকে বড় করে দেখাই স্বাভাবিক।
সন্তানের প্রতি পিতামাতার প্রত্যাশা: প্রত্যেক মা-বাবাই চান তাদের সন্তান বড় কিছু হোক। মানুষের মতো মানুষ হোক। সমাজের বুকে মাথা তুলে দাড়াঁক। সন্তানের নাম, যশ ও খ্যাতি হলে মা-বাবার বুক গর্বে ভরে ওঠে। সন্তানের দু:খ বেদনা কোনো মা-বাবা কামনা করেন না। মা-বাবা সবসময় কামনা করেন তাদের সন্তান ভালো থাকুক।
পিতা-মাতার প্রতি করণীয়: পিতা-মাতা পরম স্নেহে সন্তানকে লালন করলেও তারা সন্তানের প্রতি এমন কোনো দাবি প্রকাশ করে না। প্রতিদান হিসেবে সন্তানের কাছে পিতা-মাতা মোটা অঙ্কের অর্থ কিংবা অন্য কোনো বিনিময় প্রত্যাশা করেন না। তবু পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের অনেক করণীয় ও দায়িত্ব রয়েছে। পিতা-মাতাকে সম্পূর্ণ আন্তরিক শ্রদ্ধার সঙ্গে দেখতে হবে। তাদের অসুস্থতায় সর্বাগ্রে সন্তানকে এগিয়ে আসতে হবে, তাদের উপযুক্ত সেবা নিশ্চিত করতে হবে। পিতা-মাতা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের ব্যক্তিগত সীমাবদ্ধতার কথা সন্তানকে বুঝতে দিতে চান না, সেক্ষেত্রে সন্তানের উচিত নিজে উদ্যোগী হয়ে পিতা-মাতার প্রতি উদার ব্যবহার করা। পিতা যদি উপার্জনে অক্ষমও হন, সন্তানের উচিত নয় পিতাকে সহযোগিতা না করা; এমনকি পিতা-মাতার ভুল কাজেও সন্তানের কঠোর আচরণ করা সংগত নয়। পিতা-মাতার সঙ্গে পরম আত্মীয়সুলভ আন্তরিক আচার ব্যবহার করতে হবে যাতে পারিবারিক জীবন হয়ে ওঠে আনন্দমুখর।
পিতা-মাতার সন্তুষ্টিতে করণীয় দায়িত্ব ও কর্তব্য: যুগে যুগে যেসব মহামানবকে জগতের শ্রেষ্ঠ মানব হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়, তাদের জীবন পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তারা ছিলেন পিতা-মাতার প্রতি অসীম শ্রদ্ধাশীল। মাতার সন্তুষ্টির জন্য বালক বায়েজিদ বোস্তামি নিদ্রাহীন রাত পার করেছিলেন। মা খুশি হয়ে স্রষ্টার কাছে আশীর্বাদ কামনা করলেন। পরবর্তী সময়ে বায়েজিদ আল্লাহর প্রিয় মানুষে পরিণত হয়েছিলেন। মায়ের সন্তুষ্টি বালক বায়েজিদের জীবনে যে উন্নতি বয়ে এনেছিল, তা ছিল পৃথিবীবাসীর জন্য একটি বড় উদাহরণ। পক্ষান্তরে পিতা-মাতার অসন্তুষ্টি সন্তানের জন্যে অমঙ্গলেরও কারণ। ইসলামে আছে, ‘পিতা-মাতা যদি সন্তানের প্রতি সন্তুষ্ট থাকেন, তাহলে স্রষ্টা নিজেও তার বান্দার প্রতি সন্তুষ্ট থাকেন।’ তাই সবার উচিত পিতা-মাতার প্রতি যত্নবান হওয়া, যাতে তারা সন্তুষ্ট থাকেন।
পিতা-মাতার বার্ধক্যে করণীয়: প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে সবাইকে বার্ধক্যে উপনীত হতে হয়। বার্ধক্য মানুষের স্বাভাবিক কর্মতৎপরতাকে থামিয়ে দেয়। একসময়ের বলবান মানুষটিই বার্ধক্যের সিঁড়িতে এসে বলহীন হয়ে পড়ে। শারীরিক সামর্থ্য হারিয়ে উপার্জন করা তার পক্ষে আর সম্ভব হয় না। ফলে অনেক সন্তানকেই দেখা যায় পিতা-মাতাকে পরিবারের জন্য বোঝা মনে করে এবং তাদের রেখে আসে বৃদ্ধাশ্রমে। সন্তান উপার্জনক্ষম অথচ তার বৃদ্ধ পিতা-মাতা থাকে বৃদ্ধাশ্রমে। এ অবস্থা কোনো সন্তান বা পরিবারের জন্য আনন্দদায়ক সংবাদ হতে পারে না। বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে সন্তানের সাধ্যমতো সেবা করা উচিত। পিতা-মাতার সুচিকিৎসা এবং প্রয়োজনীয় সেবাদান সন্তানের নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্যের মধ্যে পড়ে।
পিতামাতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল মহামানবের উদাহরণ: এ পৃথিবীতে যুগে যুগে যারা জ্ঞানের ও সত্যের পথ দেখিয়েছেন, মুক্তির বাণী উচ্চারণ করেছেন তারা সবাই পিতামাতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন, তাদের জীবনী পাঠ করলে জানা যায়, তারা কেমন মাতৃভক্ত ও পিতৃসেবী ছিলেন। উদারহণসরূপ বলা যায় মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.), আব্দুল কাদের জিলানী (রা.), বায়োজীদ বোস্তামী (রা.), হাজী মুহম্মদ মহসীন, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, স্যার সৈয়দ আহম্মদ, কামাল পাশা প্রমুখ ব্যক্তিরা অত্যন্ত মাতৃ ও পিতৃভক্ত ছিলেন।
উপসংহার: পিতা-মাতা সন্তানের জন্য শ্রেষ্ঠ আশীর্বাদ। পিতা-মাতার সতর্ক পৃষ্ঠপোষকতার ফলেই সন্তান উচ্চতর জীবনের সন্ধান লাভ করে। পিতা-মাতা ও সন্তানের বন্ধন পৃথিবীতে পরম ভালোবাসার বন্ধন। পিতা-মাতার প্রতি উপযুক্ত কর্তব্য পালনের মধ্য দিয়ে সে বন্ধন আরও সুদৃঢ় হতে পারে।