সাইম সাঈদী
ডিসেম্বরের মাঝামাঝি থেকে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি শীতকাল হলেও বাস্তবে নভেম্বর থেকেই হালকা শীত অনুভূত হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঋতুর এ পরিবর্তন লক্ষ্যকরা যাচ্ছে বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। জানুয়ারি মাসে গড় তাপমাত্রা দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল ও উত্তর-পর্বাঞ্চলে ১১ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে শুরু করে উপকূলীয় অঞ্চলে ২০-২১ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বজায় থাকে। এ সময় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ নগণ্য। শীতকালে অনেক ফুল ফোটে যেমন অশোক, ইউক্যালিপটাস, কুরচি, ক্যামেলিয়া, বাগানবিলাস, গোলাপ এবং সরিষা। এ সময় ঘনকুয়াশা হয়, পাতায় ও ঘাসে শিশির বিন্দু দেখা যায়। এই সময় রাত বড় দিন ছোট। শীত বাংলা সনের পঞ্চম ঋতু। পৌষ ও মাঘ মাস এই দুই মাস মিলে শীতকাল। শীতকাল প্রধানত শুষ্ক এবং দিনের তুলনায় রাত হয় দীর্ঘ। বাংলাদেশে শীতের সময় খেজুরের রস দিয়ে বিভিন্ন ধরনের পিঠা পায়েস খাওয়া হয়।
Thank you for reading this post, don't forget to subscribe!কারো পৌষ মাস কারো সর্বনাশ- কথাটার পরিপূর্ণ অর্থটা বুঝি বোঝা যায় এই শীত আসলে। শীত আসবে এই কথা চিন্তা করেই আমরা শীতকে ঘায়েল করবার জন্য অগ্রিম গরম কাপড় কিনে আলমারি ভরপূর করি। বাক্স থেকে বের করি দামি দামি বিদেশি সব কম্বল। গায়ে দেয়া লেপটাকে মেরামত করে মোটা থেকে আরও মোটা করে তুলি। শীতে একটু আরাম পাবার আসায়। একটু গরম থাকার আশার। উন্নত সব মার্কেটে ঘুরে ফিরি গরম কাপড় কিনতে। হাতে মোজা, পায়ে মোজা, মাথায় টুপি তারপরও কেমন যেন শীত নিবৃত হয় না।
অথচ সেই মানুষগুলো কেমন আছে? কেমন কাটছে তাদের এই শীত? তারা কীভাবে শীতের সঙ্গে লড়াই করে টিকে আছে?
একবারও ভাবি না সেটা। একটিবারের জন্যও মনের ভিতর আসে না এমন ভাবনা। সহানুভূতি জাগে না হূদয়ের কোমল মন্দিরে। আমরা বড় স্বার্থপর হয়ে পড়েছি। আমাদের অর্থ সম্পদের পরিমাণ যতটা না বাড়ে তার থেকে শতগুণ বেশি হারে বাড়ে আমার মনের ভিতরের ঘৃণ্য কৃপনতা। অর্থ সম্পদ সামর্থ্য বাড়বার সঙ্গে সঙ্গে মনটা সংকুচিত হতে থাকে। আমরা হয়ে পড়ি আত্মকেন্দ্রিক। বারবার খুঁজে ফিরি সমমানের লোকদের। টার্গেট করি আরও বেশি উন্নত, উচ্চমানের লোকজনদের সঙ্গে ওঠাবসার। চারতলায় উঠতে কম করে আটটা সিড়ির ধাপ অতিক্রম করতে হয়। আমারা ভুলে যাই চার তলায় উঠতে এই আটটি ধাপের কোনোটিই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু খুব কম মানুষেরই এমন অভ্যাস আছে যে একটা ধাপ অতিক্রম করে পিছনে ফিরে দেখেন যে এই ধাপটা আমি অতিক্রম করলাম। বেশির ভাগই একটা অতিক্রম করতে না করতেই উপরে ধাপের দিকে তাকিয়ে থাকে। মনের ভিতর উঁচুতে ওঠবার লোভনীয় নেশা চরম থেকে চরমে উন্নীত হয়। এটাই যেন স্বাভাবিক।
আমরা দামি গাড়িতে করে রোজ রাতে ফুটপাতের গলি দিয়ে পার্টি হাউস থেকে আনন্দ ফূর্তি করতে করতে বাড়ি ফিরি কিন্তু ভুলেও চেয়ে দেখি না ফুটপাতের পাশ দিয়ে খোলা আসমানের নিচে শুয়ে থাকা সর্বস্বান্ত মানুষগুলোকে। যাদের শরীরে কাপড়ের অপ্রতুলতা, নোংরা জায়গা, খোলা আকাশ, ফুটবলের মতো গোল হয়ে শীতের কষ্টে জর্জরিত মানুষগুলোর দিকে ভুলেও তাকাই না। দেখতে দেখতে এটা যেন কেমন একটা স্বাভাবিক বিষয় হয়ে গেছে। আমরা ভাবি ওরা এমন করেই এত কাল যাবত্ থাকছে। এখনও আছে এবং ভবিষ্যাতেও থাকবে। এটা নিয়ে ভাবার আর কি হলো। এ বিষয়ে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তাদের (বিত্তশালী) ধনসম্পদে অভাবগ্রস্ত ও বঞ্চিতদের অধিকার রয়েছে’ (সূরা জারিয়াত: ১৯)।
আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেন, ‘তারা আল্লাহর সন্তুষ্টি তথা তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে দরিদ্র, এতিম ও বন্দিদের খাদ্য দান করে’ (সুরা দাহর-৮)।
হজরত আবু সাঈদ (রা.) বলেন, হুজুর (সা.) বলেছেন যে, ‘কোনো মুসলমান অপর মুসলমানকে বস্ত্রহীনতা থেকে ঢাকতে কাপড় দিলে আল্লাহপাক তাকে জান্নাতের সবুজ কাপড় পরাবেন’ (তিরমিজি)। রাসুলুল্লাহ (সা.) অন্যএকটি হাদিসে বলেছেন, ‘তোমরা ক্ষুধার্তকে খাদ্য দাও, অসুস্থ ব্যক্তির খোঁজখবর নাও, বস্ত্রহীন লোকদের বস্ত্র দাও এবং বন্দিকে মুক্ত করে দাও’ (বুখারি)।
অপর আর এক হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, ‘হে বনি আদম! যদি উদ্বৃত্ত অর্থ দান কর, তাহলে ভালো হবে আর আটকে রাখলে ক্ষতি হবে’ (আবু দাউদ)। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘বান্দা যতক্ষণ তার ভাইকে সাহায্য করে, আল্লাহ ততক্ষণ বান্দাকে সাহায্য করে থাকেন’।
রাসুল (সা.) আরও বলেন, ‘যে ব্যক্তি দুনিয়াতে অপরের একটি জরুরত মিটিয়ে দেবে, পরকালে আল্লাহ তার ১০০ হাজত পূরণ করে দেবেন এবং বান্দার দুঃখ-দুর্দশায় কেউ সহযোগিতার হাত বাড়ালে আল্লাহ তার প্রতি করুণার দৃষ্টি দেন’ (মুসলিম শরিফ)।
মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। সমাজে সেই মানুষেরই একটা অংশ গরিব-দুস্থ। তারা আমাদের সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ। মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার ন্যূনতম মৌলিক অধিকারগুলো তাদেরও ন্যায্যপ্রাপ্য। তাই গরিব-অসহায়, দুস্থের প্রতি আন্তরিক ভালোবাসা প্রদর্শন ও সহানুভূতিশীল হওয়া অত্যাবশ্যক।
আসুন আমরা মানবিক মূল্যবোধ থেকে সবাই মিলে শীতে ফুটপাতে বা খোলা আকাশের নিচে বসবাসকারী অসহায় ছিন্নমূল মানুষের পাশে সামর্থ্যের ভিত্তিতে সহযোগিতার হাত প্রসারিত করি। শীতার্থদের মধ্যে বেশি কষ্ট পাচ্ছে ছিন্নমূল পথশিশুরা। দেখা যায় তাদের মধ্যে কেউ-কেউ প্লাস্টিকের বস্তা গায়ে দিয়ে শীতে কাঁপতে কাঁপতে রাতযাপন করছে। অনেকেই থাকেন ছেড়া কাঁথা গায়ে। অনেকে আবার পথের ধারে খড়কুটো দিয়ে সামান্য আগুন জ্বালিয়ে আগুনের তাপে বসে বসে রাত পার করছে। কিছু হতদরিদ্র লোক রয়েছে যারা অর্থের অভাবে একটি শীতের কাপড়ও জোগাতে পারছে না। অসহায়দের একটাই আশা, সামর্থ্যবানদের নিকট থেকে তারা পাবে একটি গরম কাপড়। অসহায়দের কাছে এই মৌসুমটি খুবই কষ্টকর। যাদের গরম কাপড় নেই তাদের কাবু করে রেখেছে শীত। তারা থরথর করে কাঁপতে থাকে শীতের প্রভাবে।
যশোর শহরের বিভিন্ন জায়গায় গভীর রাতে সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, শহরের বিভিন্ন বিপণিবিতানের সামনের খালি জায়গা, রেল স্টেশন ও ফুটপাতে যেসব ছিন্নমূল লোকজন রাত যাপন করছে তাদের কষ্টের শেষ নেই। গরম কাপড়ের অভাবে তারা শীতের সঙ্গে যুদ্ধ করে কোনোভাবে রাত পার করছে। আর অপেক্ষা করছে পরদিন সকালের সূর্যের জন্য।
হে সূর্য! শীতের সূর্য! হিমশীতল সুদীর্ঘ রাত তোমার প্রতীক্ষায়
আমরা থাকি
যেমন প্রতীক্ষা করে থাকে কৃষকের চঞ্চল চোখ
ধানকাটার রোমাঞ্চকর দিনগুলির জন্যে।
হে সূর্য, তুমি তো জানো,
আমাদের গরম কাপড়ের কত অভাব!
সারারাত খড়কুটো জ্বালিয়ে
এক টুকরো কাপড়ে কান ঢেকে,
কত কষ্টে আমরা শীত আটকাই!
সকালের এক টুকরো রোদ্দুর-
এক টুকরো সোনার চেয়েও মনে হয় দামি।
ঘর ছেড়ে আমরা এদিক ওদিকে যাই-
এক টুকরো রোদ্দুরের তৃষ্ণায়।
হে সূর্য!
তুমি আমাদের স্যাঁতস্যাঁতে ভিজে ঘরে
উত্তাপ আর আলো দিও
আর উত্তাপ দিও
রাস্তার ধারের ঐ উলঙ্গ ছেলেটাকে।
হে সূর্য!
সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘প্রার্থী’ কবিতায় দেখা যায়, শীতার্ত মানুষ প্রতীক্ষার প্রহর গুণে কখন সূর্য উঠবে। শীত নিবারণের জন্য তাদের বস্ত্র নেই। সারারাত খড়কুটা জ্বালিয়ে এক টুকরা কাপড়ে কান ঢেকে শীত নিবারণের বৃথা চেষ্টায় তারা কাতর। সকালের এক টুকরা সোনা রোদ তাদের কাছে সোনার চেয়ে দামি বলে মনে হয়। শীতার্ত মানুষের দুর্ভোগের বিষয়টি উদ্দীপক ও ‘প্রার্থী’ কবিতায় এ বর্ণিত হয়েছে। এ কবিতায় বর্ণিত দরিদ্র ও অসহায় শ্রেণির ভাগ্য উন্নয়নই ছিল সুকান্ত ভট্টাচার্যের উদ্দেশ্য। মূলতঃ কবি এদের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য সূর্যের মতো সমাজের উঁচু শেণির মানুষকে তাদের সহায়তায় এগিয়ে আসার আহ্বান করেছেন।
ফুটপাত, বাসস্টপ, রেল স্টেশন, সদর ঘাট, হাসপাতালের সামনে এখানে ওখানে সেখানে কত না মানুষ শীতের সঙ্গে যুদ্ধে দিনের পর দিন পরাজিত হয়ে আসছেন। যাদের জয়-পরাজয় নিয়ে কখনো কোনো মিছিল মিটিং সামবেশ হয় না। যাদের বাঁচা-মরার খবর বাসি পচা ময়লা আবর্জনা আর পচা কলার খোসার সঙ্গে মিশে যায়। আর এদিকে আমরা বিএমডব্লিউ গাড়িতে চরে, এসি রুমে ঘুমিয়েও ভবিষ্যত্ নিয়ে চিন্তা করতে লিটার লিটার মদ খেয়ে সাবার করছি। নিজের প্রাপ্ত কোনো কিছু নিয়ে আমরা কখনো খুশি থাকতে পারছি না।
আসুন আমরা সবাই মনটাকে একটু নরম করে আর্তমানবতার সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করি। নিজের ভিতরে লুকিয়ে থাকা মানবতাকে বাইরে বের করে আনি। যে মুখগুলো না হাসতে হাসতে হাসির কথা ভুলেই গেছেন। যাদের মুখ নীরবে কাঁদে হাসি হারার বেদনায় সেই মুখগুলোতে হাসি ফোটায়। আপনার একটা পড়ে থাকা একটা শীতের কাপড় যেটা কি-না আপনার বাসার ফ্লোর মোছার কাজেও আসবে না সেইটা কিন্তু একটা মানুষের পুরা শীতকালটাকেই বিদায় করে দিবে। শীত যুদ্ধে জয়ী হবে